আমদানি পর্যাপ্ত, তবে জ্বালানি সংকটে পরিশোধন কমায় রেকর্ড ছাড়িয়েছে চিনির দাম
দেশে চাহিদার তুলনায় আমদানি পর্যাপ্ত হলেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে পরিশোধন কমে যাওয়ায় বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিনির দাম। খাত সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
পণ্যটির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার প্রতিকেজি খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ৯০ টাকা। অথচ বাজারে এখন প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। গত ৩ দিনে খুচরা পর্যায়ে পণ্যটির দাম কমপক্ষে ২০ টাকা বেড়েছে।
চিনি আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, দেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ চিনি আমদানি হয়েছে, সেটি চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মিলগুলোর চিনির পরিশোধন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, "আমাদের দৈনিক ৫ হাজার টন চিনির পরিশোধন ক্ষমতা থাকলেও গ্যাস সংকটের কারণে তা ২ হাজার টনের নিচে নেমে এসেছে। চিনি কারখানায় আমাদের গ্যাসের চাপ দরকার ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট)। কিন্তু আমরা পাচ্ছি ৪ পিএসআই।"
একইভাবে, মেঘনা গ্রুপের দৈনিক ৩ হাজার মেট্রিক টন চিনির পরিশোধন ক্ষমতা থাকলেও তা এখন নেমে এসেছে ২ হাজার টনের নিচে।
ট্যারিফ কমিশন ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৯ লাখ টন, যা প্রতিমাসে প্রায় ১ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু চাহিদার চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ার পরও বাজারে পণ্যটির সংকট তৈরি হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি অর্থ বছরের (২০২২-২০২৩) প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৭ লাখ ৮৬ হাজার টন চিনি আমদানি করেছে বেসরকারি মিলগুলো। সেই হিসেবে, প্রতিমাসে গড়ে চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৫০০ টন, যা দেশের প্রতিমাসের গড় চাহিদার তুলনায় বেশি।
এরমধ্যে, সর্বশেষ গেল অক্টোবরে ১ লাখ ৫৪ হাজার সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৮৩ হাজার, আগস্টে দুই লাখ ৬৭ হাজার এবং জুলাইতে ১ লাখ ৮২ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছে।
এদিকে পরিশোধন ব্যাহত হওয়ায় সরবরাহ সংকটে অস্থির হয়ে উঠেছে চিনির দাম। সর্বশেষ গত তিন দিনে খুচরা পর্য়ায়ে চিনির দাম বেড়েছে কমপক্ষে ২০ টাকা।
বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) চট্টগ্রামে প্রতিকেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে ১২৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১০৫ টাকার নিচে।
চট্টগ্রামের জান্নাত স্টোরের স্বত্বাধিকারী নুরুল আবছার বলেন, "গত সপ্তাহের তুলনায় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতিকেজি চিনির দাম বেড়েছে ১৯ টাকা পর্যন্ত। ফলে আমাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।"
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনই বাড়ছে চিনির দাম। খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ী মেসার্স আমান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমান উল্লাহ বলেন, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনি বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ২০০ টাকায়, যা গত সোমবার পর্যন্ত ছিল মাত্র ৩ হাজার ৫০০ টাকা। সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে চিনির দাম আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা আমান উল্লাহসহ বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের।
টিসিবির তথ্যে দেখা গেছে, চিনির দাম কেজিপ্রতি ২২ শতাংশ বেড়ে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা হয়েছে, যা এক মাস আগেও ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। গত বছরের তুলনায় এখন চিনির দাম ৪৫ শতাংশ বেড়েছে।
চিনিকল বন্ধ
চিনি পরিশোধন মিলগুলোর অন্যতম এজেন্ট খাতুনগঞ্জের আর এম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, এক সময় দেশীয় চাহিদার একটি অংশ সরবরাহ করতো রাষ্ট্রয়াত্ত্ব ১৫টি চিনিকল। পাশাপাশি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখতো।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুটি সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার পাশাপাশি নানান সংকটে বেসরকারি মিলগুলোর পরিশোধন সক্ষমতা অর্ধেকের নিচে নেমে আসায় মিল থেকে খোলা বাজারে চিনির সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাবে প্রায় প্রতিদিনই এ নিত্য পণ্যের দাম বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই বিষয়ে বিএসএফআইসি'র প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. মাযহার উল হক খান বলেন, দেশের সরকারি পর্যায়ে পরিচালিত ১৫টি মিলের মধ্যে দুই বছর ধরে ৬টি মিলের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া, চালু মিলগুলোর উৎপাদন কমে গেছে। ফলে বর্তমান সংকটেও খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশন চিনির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না বলে মনে করছেন তিনি।
বিএসএফআইসির তথ্যমতে, এক সময় ১৫টি মিলে প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ টনের বেশি চিনি উৎপাদন হতো। সর্বশেষ মৌসুমে গত বছর ৯টি মিলে চিনি উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার ৫০০ টন। চলতি মাসের শেষ দিকে শুরু হওয়া নতুন মৌসুমে ৯টি মিলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার টন।