রেমিট্যান্স প্রেরকদের জন্য বিশেষ সুবিধাসহ বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ী স্কিম চালুর কথা ভাবছে সরকার
দেশে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিকদের একটি প্যাকেজের আওতায় নানাবিধ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রেখে একটি নতুন নীতির খসড়া তৈরি করছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। প্যাকেজটির আওতায় তাদের জন্য এই প্রথম বাধ্যতামূলক করা হবে বিশেষ কিছু সুবিধাযুক্ত সঞ্চয়ী স্কিম।
সঞ্চয়ী স্কিমে রেমিট্যান্স প্রেরকদের আয়ের একটি অংশ রাখা হবে, তার সঙ্গে সরকার নিজেও কিছু অর্থ দেবে। দেশে আসার পর সমুদয় অর্থ সুদসহ ফেরত পাবেন তারা।
প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসার পর এই তহবিল– নতুন উদ্যোগ শুরু, ব্যাংকিং পরিষেবায় অংশগ্রহণ এবং ক্ষুদ্র ঋণের মতো উৎপাদনশীল উদ্যোগ ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনায় কাজে লাগাতে পারবেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানান, 'ন্যাশনাল রিইন্টিগ্রেশন পলিসি ফর মাইগ্রেন্টস' শীর্ষক এ নীতি প্রধানত দুটি কারণে– রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী করে দেশের ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং প্রবাস ফেরতদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'সেভিং স্কিমের মূল ধারণাটি হলো– রেমিট্যান্স প্রেরকরা সরকারকে তাদের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ দেবে এবং তার সাথে সরকারও কিছু অর্থ যোগ করবে। তারা যখন দেশে ফিরবেন, তখন সুদসহ সম্পূর্ণ অঙ্কটা তারা ফেরত পাবেন'।
'যেমন কোনো প্রবাসী যদি ১০০ টাকা রেমিট্যান্স পাঠান, আমরা সেখান থেকে ১০ টাকা নেব এবং তার সাথে আরও ৫ টাকা যোগ করব। এই ১৫ টাকা ব্যাংক হিসাবে রাখা হবে। যখন তিনি দেশে আসবেন তাকে সুদসহ এই টাকা ফেরত দেয়া হবে'।
রেমিট্যান্স প্রাপ্তির ওপর ভিত্তি করে প্রবাস ফেরত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছু বিশেষ সুবিধা (সেটা হতে পারে বিভিন্ন অফার বা উপহার) প্যাকেজ আকারে দেওয়া হবে।
অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার প্রসঙ্গে সচিব এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুনিরুছ সালেহীন বলেন, 'ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হবে'।
'সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অনুমোদন লাভের পর, আমরা নতুন নীতির আওতায় দেওয়া প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করব। এরপর আমরা ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোব নেব, যাতে রেমিট্যান্স প্রেরকরা আনুষ্ঠানিক বা ব্যাংকিং চ্যানেলে আয় পাঠাতে আরও উৎসাহী হয়'- যোগ করেন তিনি।
প্রবাসীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সামাজিক- মনস্তাত্ত্বিক ভাবে সমাজে একীভূত করার বিস্তৃত নানান পদক্ষেপ ও পরিষেবা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো থাকবে এই পুনঃএকত্রীকরণ নীতিতে। যার মধ্যে থাকবে প্রবাস ফেরতদের তথ্য ডেটাবেজে সংরক্ষণ, তাদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার স্থাপন এবং উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
বৈধ চ্যানেলে আয় পাঠাতে উৎসাহিত করতে বর্তমানে সরকার রেমিট্যান্সের ওপর ২.৫ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে, যা আগে ছিল ২ শতাংশ।
এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর প্রবাস ফেরতদের জন্য নতুন একটি বীমা স্কিম চালু করা হয়। বিদেশের কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বা অঙ্গহানি হলে এর আওতায় ১০ লাখ টাকা বিমাদাবি করতে পারবেন তারা, যা আগে ছিল ৪ লাখ টাকা।
আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো উৎসাহিত করতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
নতুন নীতির অধীনে, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর গুরুত্বকে প্রচার করবে এবং অভিবাসীদের জন্য, বিশেষ করে প্রত্যাবর্তনকারী মহিলা অভিবাসীদের জন্য ডিজিটাল ওয়ালেট ট্রান্সফারসহ নমনীয় আর্থিক পরিষেবাগুলো প্রসারিত করবে।
রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে অভিবাসীদের জন্য সঠিক বাজেট ব্যবস্থাপনা, আর্থিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ লাভের ব্যবস্থাও চালু করা হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)'র পরামর্শক আসিফ মুনির টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এক কোটির উপরে প্রবাসী রয়েছেন। তারা দেশে ফেরত আসার পরে যাতে অর্থনৈতিক সুবিধাগুলোর আওতায় থাকতে পারেন; সে লক্ষ্য নিয়ে, অভিবাসনখাতের বিভিন্ন অংশীজনদের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে সরকার খসড়া নীতিমালায় এসব প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। এগুলো এমনভাবে প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে তা রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে'।
তিনি বলেন, 'প্রবাসীরা যে টাকা পাঠাবে তা থেকে একটা সুনির্দিষ্ট অংশ বাধ্যতামূলকভাবে একটা অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যাবে। এটা বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে তারা ফেরত পাবে। মূল টাকার সাথে হয়ত স্কীমের আওতায় বিভিন্ন রকম ইনসেনটিভ থাকতে পারে'।
বিশেষ সুবিধার প্যাকেজের বিষয়ে আসিফ মুনির জানান, "ব্যবসায়িক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যেমন ব্যাংকের কাছ থেকে নানান সুবিধা লাভ করেন, বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে একই রকম সুবিধা বা কোনো উপহার পাবেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। এছাড়া, বিভিন্ন বিনিয়োগের ভিত্তিতে তারা সুবিধা পাবেন।"
তবে এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই নীতি বাস্তবায়নের আগে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করা উচিত।
তার মতে, 'এটা যেহেতু নতুন নীতি, তাই আগে এক ধরনের ট্রায়ালের মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত আমাদের। এক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকিও থাকবে,। তাই মনিটরিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। নজরদারির জন্য আর্থিক লেনদেন বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল গঠন করা যেতে পারে'।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ জনশক্তি রপ্তানির উৎস, এবং রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।
চলতি বছরে (নভেম্বর পর্যন্ত) প্রায় ১০.২৮ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে গেছেন, ডিসেম্বরের শেষে তা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানাচ্ছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য এবং মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। আর তখনই নতুন করে গুরুত্ব পায়– বিদেশে কর্মরত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক।
গত অর্থবছরে, তারা ২১ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠান, যা ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সস্তা (বিনিময় হারের হিসাবে) এবং অনায়সে বৈদেশিক মুদ্রা আয়।
বর্তমানে যেহেতু ডলারের সংকটের সময়ে সরকার অভিবাসন এবং রেমিট্যান্স প্রবাহকে আরও বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছে; তাই কর্তৃপক্ষকে প্রবাসীদের আগের চেয়ে আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হুন্ডিতে ডলার পাঠালে বিনিময় দর বেশি পান প্রবাসীরা। তাই কর্মকর্তারা আশা করছেন, এসব সুযোগ-সুবিধা অবৈধ হুন্ডির পরিবর্তে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি ডলার দেশে পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'অভিবাসীরা দেশে ফেরত আসার পরে যাতে তাদের নানারকম অসুবিধার মধ্যে পড়তে না হয়, সেজন্য সঞ্চয় স্কিম প্রমোট করা যেতে পারে। কিন্তু, এটার সাথে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের মতো মূল সমস্যাগুলোর দিকেও নজর দিলে তাদের সঞ্চয়ের সুযোগগুলো আরও বাড়তো। তাই এ স্কিমের ফলে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল থেকে বৈধ চ্যানেলে কত টাকা আসবে তা এখনই বলা যাবে না। কারণ অনেক কিছুই এখনও স্পষ্ট না'।
তার মতে, 'এখানে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ঠিকভাবে আছে কি-না সেটাও দেখতে হবে। সেটা ঠিকভাবে না থাকলে এটা শেষপর্যন্ত প্রবাসীদের আরও নিরুৎসাহিত করবে। এই নীতি অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে প্রস্তুত করা হলে– দেশ এবং প্রবাসী কর্মীরা সব দিক থেকেই লাভবান হবে'।
দিকে জুলাইয়ে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর টানা তিন মাস ধরে কমে রেমিট্যান্সের গতি। নভেম্বরে আগের মাসের তুলনায় ৪.৫৪ শতাংশ বাড়ে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি। এসময় প্রবাসীরা (আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে) ১৫৯ কোটি ডলার দেশে পাঠান।
ডলার সংকটের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মুদ্রা স্থানান্তর নীতি শিথিল করা, লেনদেন ফি ছাড় এবং বিদেশে মানি এক্সচেঞ্জ শপের সংখ্যা বাড়ানোর মতো রেমিট্যান্স প্রবাহ চাঙ্গা করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়।
এছাড়া, বিকাশ, রকেট এবং ইউপে'র মতো জনপ্রিয় মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতাদের বিদেশি সহযোগিদের সাথে অংশীদারত্বে রেমিট্যান্স সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে তিন ধাপের লেনদেন প্রক্রিয়া এক ধাপে সম্পন্ন হওয়ায়, আরও সহজে ও দ্রুত অর্থ দেশে পাঠানো যাবে।