ডিসেম্বরে বেড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ, ২০২২ সালে ১১.২৫ লাখ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের রেকর্ড
সদ্য সমাপ্ত ২০২২ সালের শেষে দেশে রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে। গেল বছর ১১.২৫ লাখ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের রেকর্ড নিয়ে টানা দ্বিতীয় মাসের মতো ডিসেম্বরেও রেমিট্যান্স প্রবাহে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বছরে (ইয়ার অন ইয়ার) ৪.২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১.৭ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। যদিও আগের বছর একই সময়ের তুলনায় কিছুটা কম ২০২২ সালের এই আয়।
বছর শেষে বিদেশি শ্রমিকদের পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১.২৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ২২.০৭ বিলিয়ন ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিনিময় হারের অমিলের কারণে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেনের বৃদ্ধি পাওয়ায় সদ্য সমাপ্ত বছরে আয় কিছুটা কমেছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, জনশক্তি রপ্তানিতে ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আয়ের এই পরিমাণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাদের বলছেন, বিদেশে নতুন নিয়োগ পাওয়া শ্রমিকদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে আরও কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। প্রধান কয়েকটি গন্তব্য দেশে চাহিদা বৃদ্ধি এবং বেশকিছু নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে গতবছর।
তবে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও মানসম্পন্ন অভিবাসনে এখনও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, অদক্ষ শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা আগের বছরের ৭৫.২৪ শতাংশ থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৭৮.৬৪ শতাংশ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় খুলে দেওয়া, তেলের দাম বৃদ্ধিতে উপসাগরীয় অর্থনীতির উন্নতি এবং কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় শ্রমিকদের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। ফলে বাড়ছে বিদেশে নতুন কাজ প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের সংখ্যা।
এছাড়া, সৌদি আরবের সব ফার্মে বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে, যা বিদেশে শ্রম অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে বলে মনে করছেন তারা।
সৌদি আরবসহ প্রধান গন্তব্য দেশগুলো ইতোধ্যেই তাদের উচ্চ শ্রম চাহিদার কথা জানিয়েছে। ফলে খাত সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, গেল বছরের মতো সদ্য শুরু হওয়া ২০২৩ সালেও জনশক্তি রপ্তানিতে উর্ধ্বমুখীতা বজায় থাকবে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশিদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ১০ লাখ অতিক্রম করলেও এর পরের বছরগুলোতে তা কমতে থাকে। করোনা মহামারিজনিত বিধিনিষেধের কারণে ২০২০ সালে এই সংখ্যা ২.১৭ লাখের নিচে গিয়ে ঠেকে।
বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৯৩ হাজার ৭৫০ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছেন; মহামারি শুরুর আগের সময়ে গড় এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার।
গত বছরের শুধু ডিসেম্বরেই মোট ৯৫ হাজার ৯৮৮ জন শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমান।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের শীর্ষ গন্তব্য হলো সৌদি আরব। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সমস্ত বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৫৬ শতাংশই হয়েছে এই দেশে। এরপরে রয়েছে ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কাতার, কুয়েত ও জর্ডান।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ শ্রমিককে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা মাসিক বেতন দিয়ে পরিষ্কার, নির্মাণ কাজ এবং ঘরের কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি, কিছু শ্রমিককে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে নিরাপত্তারক্ষী এবং ড্রাইভার হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।"
এছাড়া, কিছু দক্ষ ও স্বল্পদক্ষ শ্রমিক প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান বা রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনার টেকনিশিয়ান হিসেবে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
২০২২ সালে নতুন ও পুনরায় খোলা শ্রম বাজার
২০২২ সালে নতুন করে মালয়েশিয়া, ইতালি ও গ্রিসে কর্মী নেওয়া শুরু হয়েছে। মোট ৪ বছর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ রাখার পর গেল বছরের আগস্ট থেকে পুনরায় বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী নেওয়া শুরু করেছে মালয়েশিয়া। নভেম্বর পর্যন্ত ২৭ হাজারের বেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে দেশটি।
এছাড়া, ২০২২ সালের প্রথম ১১ মাসে অন্তত ৬ হাজার ৬০০ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে ইতালি।
গেল শেষ ফেব্রুয়ারিতে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে গ্রিসের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, গ্রিসে বৈধভাবে ৪ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করার সুযোগ পাবেন।
এছাড়া, কোরিয়ান এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসল) গত বছরের নভেম্বরের পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি কর্মী পাঠিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বেশি বেতন, শ্রম অধিকার এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে পাঠানো হয়েছে এই কর্মীদের।
এদিকে, গত জুলাই পর্যন্ত পোল্যান্ডে অভিবাসন করেছেন ১০৩ জন।
পূর্ব ইউরোপের বাংলাদেশিদের নতুন শ্রমবাজার রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মলদোভায় পুরুষ কর্মীর পাশাপাশি নারী কর্মীদেরও চাহিদা রয়েছে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (আরএমএময়ারইউ)-এর তথ্য অনুসারে, ইমারত নির্মাণ, জাহাজ শিল্প, কৃষিকাজ, কলকারখানা, গার্মেন্টস, বেবি সিটিং ও রেস্তোরাঁ কর্মী হিসেবে গত দুই বছরে সেখানে ১০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী পাড়ি জমিয়েছেন।
এছাড়া, গেল বছরের মে পর্যন্ত নতুন শ্রমবাজার আলবেনিয়ায় অভিবাসন করেছেন ৭৯৪ জন বাংলাদেশি কর্মী।
উচ্চ অভিবাসনের সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়
বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের অভিবাসন বাড়লেও আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে ৭৮৭ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স কম এসেছে।
উচ্চ অভিবাসন সত্ত্বেও ২০২২ সালে রেমিট্যান্স কমার বিষয়ে আরএমএমআরইউ-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, "আন্তর্জাতিক অভিবাসনের প্রথম বছরেই অভিবাসী কর্মী রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে না। অভিবাসনের দ্বিতীয় বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে বৃদ্ধি দেখা দেয়।"
সরকারি প্রণোদনা বাড়লেও কেনো রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়েনি, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "অসংখ্য অভিবাসী শ্রমিক ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠায়। কিন্তু গত বছর এ নিয়ে কিছু নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হওয়ায় এবং অন্যান্য আরও কিছু কারণে ব্যাংকগুলোর ওপর অভিবাসী শ্রমিকদের আস্থা হ্রাস পেয়েছে।"
"অভিবাসীরা মনে করছেন, যদি তারা ব্যাংকে টাকা জমা দেন, তাহলে তা ফেরত নাও পেতে পারেন; কিংবা ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। ফলস্বরূপ, তারা হুন্ডি বা অন্যান্য মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।"
ব্যাংকগুলোর প্রতি অভিবাসীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রচারণামূলক উদ্যোগ নেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেন তাসনিম সিদ্দিকী। এর মাধ্যমে তিনি ব্যাংকিং খাতকে একটি স্থিতিশীল খাত হিসেবে প্রচারের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, "পেনশন স্কিমের অধীনে প্রণোদনা বাড়ানো গেলে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। কয়েক মাস ধরে অল্প অল্প করে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে প্রণোদনা।"
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাসোসিয়েশনস অফ ব্যাংকার্স (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রেমিট্যান্সের ডলারের রেট নির্ধারণ করে দেওয়ার পর রেমিট্যান্স আসা কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে, বেড়েছে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা। তবে এর পরিমাণ খুব বেশি হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তারা।
এমনকি গতকাল এক যৌথ বৈঠকে, এবিবি ও বাফেদা রপ্তানিকারকদের জন্য হার সংশোধন করলেও রেমিট্যান্স প্রেরকদের ডলার বিনিময় হার ১০৭ টাকাতেই অপরিবর্তিত রাখা হয়।
ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার পাচার বন্ধ না হলে হুন্ডির জনপ্রিয়তা কমবে না উল্লেখ করে তারা বলেন, হুন্ডি ডলারের চাহিদা এরকম থাকলে, রেমিট্যান্সের ডলার হার বাড়ালেও রেমিট্যান্স প্রবাহ খুব বেশি বাড়বে না।
রেমিট্যান্স বাড়াতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তারা।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "রেমিট্যান্স আনতে সরকারের পক্ষ থেকে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কারণে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে; তাই বিভিন্ন দেশে বসবাস করা আমাদের শ্রমিকদের হাতে সঞ্চয়ের পরিমাণ কমার কথা। রেমিট্যান্স কমার পেছনে এটি একটি অন্যতম কারণ। তবে আমরা রেমিটারদের উৎসাহ দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।"