ঋণ পুনঃতফসিল সহজ হওয়ায় জুলাই-সেপ্টেম্বরে ‘রাইট-অফ’ কমেছে ৪৩%
দীর্ঘদিন খেলাপি হয়ে থাকা গ্রাহকের ব্যাংক ঋণ আদায়ে 'রাইট-অফ' বা ঋণ অবলোপন পদ্ধতি কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে দেশের ব্যাংকগুলোর রাইট-অফ ঋণ বার্ষিক (ইয়ার-অন-ইয়ার) প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছর একই সময়ে রাইট অফ ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১০ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যাংকগুলোর কাছে এখন খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সহজ সুবিধা থাকায় এই পদ্ধতির ব্যবহার কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণের ১১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৬২ কোটি টাকা।
২০০৩ সালে ব্যাংকিং খাতে লোন রাইট-অফ স্কিম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর নিয়মিত ঋণের ০.২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ প্রভিশন রাখার নিয়ম থাকলেও খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে এই সীমা ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু রিট-অফের ক্ষেত্রে, পুরো ঋণের পরিমাণটিই প্রভিশন হিসাবে রাখতে হয়।
ব্যাংকাররা বলছেন, আগে পুনঃতফসিল করতে হলে কেইস টু কেইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দারস্থ হতে হতো। এছাড়া, খেলাপি ঋণের বয়স তিন বছরের বেশি হয়ে গেলে, পুনঃতফসিল করতে না পেরে বাধ্য হয়ে লোন রাইট-অফ করতে হতো। তবে এখন সকল সুবিধা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হাতে, তাই সহজেই ঋণ পুনঃতফসিল করে নেওয়া যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদকে ঋণ পুনঃতফসিলকরণের ক্ষমতা দেয়।
এছাড়া, গত বছরের একই মাসে ব্যাংকের জন্য প্রবর্তিত নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়, খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ২.৫ থেকে ৪.৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট করতে হবে। এর আগে, ঋণ নিয়মিতকরণের জন্য পরিশোধ করতে হতো (ডাউন পেমেন্ট) ঋণের ১০ থেকে ৩০ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংক যদি কোনো খেলাপি গ্রাহকের ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে মুছতে (রাইট-অফ) চায়, তাহলে ব্যাংকটিকে তার মুনাফা থেকে শতভাগ প্রভিশনিং করতে হবে। কিন্তু যদি মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা যায়, তবে সেটিই ভালো।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছরজুড়ে অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে; এছাড়া খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে ঋণ স্বাভাবিক করে যে পরিমাণ আদায় করা যায়, তা-ই ব্যাংকের জন্য ভালো। এ কারণে ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আহসান আই মনসুর টিবিএসকে বলেন, "একজন গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, তার সেই সক্ষমতা নেই- সেই ঋণকে পুনঃতফসিল করে দেওয়া হলো ব্যাংকগুলোর চতুরতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই জায়গায় শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত।"
"একজন ভালো গ্রাহক যেকোনো কারণে খেলাপি গ্রাহক হতে পারে, তার অবস্থা বুঝে যদি তার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকে, তাহলে তাকে পুনঃতফসিল করে সুযোগ দেওয়া উচিত। ব্যাংকের বোর্ড ভালো হলেই এটি সম্ভব," যোগ করেন তিনি।
ব্যাংক যদি প্রফিটে না থাকে, কোথা থেকে প্রভিশনিং করবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "যে সমস্ত ব্যাংক প্রফিটে নেই, তাদের মূলধন থেকে প্রভিশনিংয়ের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেটে রাখতে পারে। তবেই ব্যাংকগুলোর খেলাপি গ্রাহক কমবে এবং ব্যাংকগুলো ভালো গ্রাহককে ঋণ দেবে।"
করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে ২০২০ ও ২০২১ সালে ছাড় পেয়েছিলেন ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহকরা। এর ফলে নিয়ন্ত্রণেই ছিল খেলাপি ঋণ। তবে এই সুবিধার মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত বছর থেকে বাড়তে শুরু করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরুতে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১.০৩ লাখ কোটি টাকা। জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১.২৫ লাখ কোটিতে এবং সেপ্টেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১.৩৪ লাখ কোটি টাকায়।
এদিকে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ৩৫০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদ মওকুফ হয়েছে ২১২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার ঋণের সুদ মওকুফ করেছে। অথচ এ সময় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক ছিল।
এছাড়া, ২০২০ সালে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালে ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করা হয়েছিল। তবে বিদায়ী বছরের প্রথম নয় মাসে ব্যাংকগুলো ৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ঋণের সুদ মওকুফ করেছে।