আইএমএফকে দেওয়া সংস্কার প্রতিশ্রুতি কি এবার কাজ করবে?
বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তবে এর সঙ্গে সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি করার জন্য বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে সংস্থাটি। ভালো খবর হচ্ছে, বাংলাদেশ চলতি মাসেই ঋণের প্রথম কিস্তি পাবে, যা ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ব্যালান্স অভ পেমেন্ট ঘাটতিকে খানিকটা স্বস্তি দেবে।
তবে আগামী ৪২ মাসে ঋণের বাকি কিস্তিগুলো পাওয়ার জন্য সরকারকে সংস্কারের পথে থাকতে হবে।
সর্বশেষ পূর্বাভাসে বৈশ্বিক ধাক্কা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধারের প্রক্ষেপণ করেনি আইএমএফ। সংস্থাটির সাম্প্রতিকতম পূর্বাভাস অনুসারে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ২০২৬-২৭ অর্থবছরের আগে মহামারিপূর্ব অবস্থায় ফিরবে না। আগামী বছর কিছু সূচক আরও খারাপ হতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের বিশ্বাস, গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে বাংলাদেশের জন্য আইএমএফ ঋণ অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংস্কারের অগ্রগতির ওপরই নির্ভর করতে পারে ঋণের কিস্তি সময়মতো পাওয়া। এগুলোকে শুধু প্রস্তাব ও ভুলে যাওয়ার বিষয় হিসাবে বিবেচনা না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাদের পরামর্শ, এগুলোকে শর্ত হিসাবে গ্রহণ করে মেনে চলা উচিত, কারণ দেশের স্বার্থেই সংস্কার অনেক হওয়া উচিত, শুধু আইএমএফের ঋণ পাওয়ার জন্য নয়।
বাংলাদেশ আইএমএফকে সময় সময় যেসব আর্থিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অন্তত ১২ বার ঋণের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল ২০১২ সালে। কিন্তু সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগ আধা-বাস্তবায়িতই থেকে গেছে, যদিও যেকোনো সুস্থ অর্থনীতির জন্য কর্তৃপক্ষের এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
উদাহরণ হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাতের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশের আর্থিক খাত ব্যাপকভাবে ব্যাংকনির্ভর। কিন্তু খেলাপি ঋণ থেকে শুরু করে দুর্বল নিয়ম-কানুন ও সুশাসনের অভাবে খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই রুগ্ন দশায় আছে।
একদশক আগে আইএমএফ'র সর্বশেষ ঋণ সহায়তার পর, একথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না যে, দেশের ব্যাংকখাতের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। অনেকে তো বলছেন, ব্যাংক খাতের দশা আরও নেতিবাচক রূপ নিয়েছে।
আইএমএফের এর চাপের কারণে সরকার ২০১৩ সালে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করে। সংশোধিত আইন অনুসারে, ঋণের তিনটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে একজন ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে সার্কুলার জারি করে নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। অবশেষে এখন ছয়টি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার পর একজন ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
এছাড়া ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে কোভিড মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ঋণ পরিশোধের নিয়মাবলি আরও শিথিল করা হয়। এরপর ঋণগ্রহীতারা ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ ও সহজ পুনঃতফসিল পান। ২০১২ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা ছিল, সেখানে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
একইভাবে বাংলাদেশকে আগেরবার ঋণ দেওয়ার সময় আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল—কর ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন বাস্তবায়ন ও শেয়ারবাজারের ডিমিউচুয়ালাইজেশন—সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নতুন ভ্যাট আইন চালু থাকলেও ব্যবসায়ী মহলের চাপে তা বেশ কয়েকবার বদলানো হয়েছে।
এবারও আইএমএফ বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়েছে, যার বেশিরভাগই ২০১২ সালে দেয়া ঋণের সময় দেওয়া শর্তের অনুরূপ।
আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণটি দেওয়া হবে ৪২ মাসে। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ ঋণের প্রথম কিস্তি পাবে।
আইএমএফ'র তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আইএমএফের নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফান্ড (আরএফএফ) থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের অর্থনীতি বড় ঝুঁকিতে রয়েছে যা ম্যাক্রোইকোনমিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
মোটাদাগে আইএমএফ এর ঋণের সঙ্গে প্রধান চারটি ক্ষেত্রে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে—সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয় বাড়াতে রাজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, নীতি কাঠামোর আধুনিকীকরণ, ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা।
আইএমএফ বলছে, 'সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার সংস্কার করলে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত হবে। আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমালে, সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উন্নত করা হলে এবং পুঁজিবাজারের উন্নতি করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে।
এবার চাপ থাকবে
আইএমএফের শর্তানুসারে নীতিমালা বাস্তবায়ন ও সংস্কারের স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাবই রয়েছে।
যেমন, কাঠামোগত সংস্কার দেশের দুর্নীতি কমাতে ও স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এমন পদক্ষেপের ফলে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন কৃচ্ছ্রতা সাধনমূলক ব্যবস্থা সামাজিক কল্যাণের লক্ষ্যগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং দেশের দারিদ্র্যের হার বাড়াতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, এবার বাংলাদেশ আইএমএফের শর্তানুসারে নীতি ও সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য চাপে থাকবে, কারণ দেশের এখন এ ঋণ ২০১২ সালের চেয়ে বেশি প্রয়োজন।
ঋণের শর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বেশিরভাগ উন্নত দেশ ও প্রতিবেশি ভারতের মতো করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করার কথা বলেছে আইএমএফ, যা ২০১২ সালেও বলেছিল। ওই সময়কার অর্থমন্ত্রী সরকারি ভর্তুকি কমানোর জন্য জ্বালানি তেলের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করার ঘোষণা দিলেও শেষপর্যন্ত তা আর বাস্তবায়ন করেনি সরকার। তবে এবার এ বিষয়ে কঠোর আইএমএফ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সালে আইএমএফ যেসব সংস্কারের শর্ত দিয়েছিল, তার বড় অংশই বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঋণের শেষ কিস্তি পাওয়ার পর ওইসব শর্ত বাস্তবায়ন থেমে যায়।
উত্থানের টনিক নয়, বিশ্বাস নির্মাণের হাতিয়ার
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, সেগুলো যেকোনো সুস্থ অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।
ফিসক্যাল ইমব্যালেন্স কমানো, সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ, রাজস্ব আয় বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারি ঋণ ও বাজেট ঘাটতি কমানো এবং শক্তিশালী আর্থিক খাত নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের জন্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—এ বিষয়ে একমত ওই কর্মকর্তা।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশ এসব খাতে কোনো সংস্কার না করায় আইএমএফ দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। আমরা এখনও যদি এসব গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন না করি এবং ১০ বছর পর আবারও আইএমএফের এর কাছে ঋণ প্রস্তাব নিয়ে যাই, তখনও সংস্থাটি একই ধরনের শর্তারোপ করবে।'
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফ থেকে ৪২ মাসে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা অর্থনীতিকে পুনরুত্থিত করতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের মাত্র ১৫ দিনের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
কিন্তু এ ঋণের অনুমোদনকে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও ঋণ প্রসঙ্গে এর বিদেশি অংশীদারদের আস্থা পুনরুদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন তারা।
একজন কর্মকর্তা বলেন, 'এখন বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের এলসি'র [ঋণপত্র] অনুমোদন করতে চায় না । কিন্তু যখন তারা জানতে পারবে যে বাংলাদেশ আইএমএফের কর্মসূচির আওতায় রয়েছে, তখন বহির্বাণিজ্যে বাংলাদেশে সম্পর্কে আস্থার ঘাটতি আর কোনো প্রভাব ফেলবে না।'