উভয় সংকট: কাস্টমসের বাড়তি শুল্কায়ন মোকাবিলা করে টিকে থাকার চেষ্টা করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের
কিটি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের স্থানীয় একটি ইলেক্ট্রিক সুইচ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টনপ্রতি ১,৪৬০ ডলার দরে কাঁচামাল আমদানি করেছিল। কিন্তু, এর ওপর যে বড় অংকের শুল্ক ধার্য করা হয়, তাতে তিক্ত অভিজ্ঞতাই হয় তাদের।
কোম্পানির উপদেষ্টা মোহাম্মদ জাকির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'টনপ্রতি ১,৪৬০ ডলার দরে আমরা কাঁচামাল আমদানি করি, অথচ কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা তা না মেনে শুল্কায়ন করতে চায় ২১০০ ডলারে'।
এই চার্জ খুবই উচ্চ হলেও, কোম্পানিটির সামনে বিকল্প উপায়ও তেমন ছিল না। তারা যদি শুল্কায়নের দর কষাকষি করতো- তাহলে পণ্যের খালাস আটকে যেত। তখন উচ্চ পোর্ট ডেমারেজ জমে সার্বিক শুল্ক আরো বাড়তো।
জাকির বলেন, 'কেবল আমাদের নয়, প্রায় সবারই এমন অবস্থা হচ্ছে। ঋণপত্র (এলসি) কমে গেছে, এনবিআরের রাজস্ব কমে গেছে – এখন তাদের রাজস্ব দরকার। এজন্য আমাদের উপর চাপ দিয়ে রাজস্ব আদায় করছে'।
'এর ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, যার চাপ পড়ছে ভোক্তার ওপর' – যোগ করেন তিনি।
ঋণপত্র খোলায় ধস নামায়, রাজস্ব কমেছে। এখন কাস্টমস কর্মকর্তারা আমদানিকারকদের ওপর চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যাতে তাদের ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বাড়তি এই ব্যয়ের বোঝা যাচ্ছে ভোক্তার কাঁধে।
দেশের রপ্তানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনে ব্যাপকভাবে কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভর করেন। এই পরিস্থিতি তাদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পর- সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি করা পণ্য/কাঁচামালের দাম কমতে শুরু করলেও – কাস্টমস কর্মকর্তারা এখনও তা মানতে চাইছেন না।
এ ধরনের অযৌক্তিক শুল্কায়নের উদাহরণও অনেক।
এই অভিযোগকে সমর্থন করে- দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানির এমন নয়টি বিল অভ এন্ট্রি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে। আমদানি করা পণ্য বন্দরে এসে পৌঁছানোর পর আমদানিকারকরা 'বিল অভ এন্ট্রি' জমা দেন আমদানিকারক বা কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এজেন্টরা।
এগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ইনভয়েস বা আমদানি মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ২ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি মূল্য ধরে শুল্কায়ন করেছে, এতে তাদের আমদানি শুল্কও বেশি দিতে হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'এ কারণে আমাদের বাড়তি কয়েক কোটি টাকা শুল্ককর হিসেবে দিতে হয়েছে। এটি আমাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়েছে, যা ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে'।
উচ্চ আমদানি মূল্যের ওপর পরবর্তীতে ভ্যাট অফিস বাড়তি ভ্যাট আদায় করবে বলেও আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা।
প্রকৃত আমদানি মূল্যের চেয়ে বাড়তি মূল্যে শুল্কায়নের শিকার হওয়ার বিষয়টি আরো তিনজন আমদানিকারক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন।
বুধবার (৮ মার্চ) এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিষয়টি তুলে এর প্রতিকার চেয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় দুই সংগঠন- মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)।
তবে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা মাসুদ সাদিক আন্ডার-ইনভয়েসিং (প্রকৃত আমদানি মূল্যের চেয়ে কম ঘোষণার) চর্চাকেই দায়ী করেন। এনবিআরের বৈঠকে তিনি বলেন, 'অনেক সময় আমদানিকারকরা প্রকৃত মূল্য ঘোষণা করেন না, এজন্য আমরা পূর্বের তিন মাসে সমজাতীয় পণ্যের শুল্কায়ন মূল্যের গড় অনুসারে আমদানি মূল্য নির্ধারণ করি'।
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিনও বলেন যে, বিভিন্ন সময়ে আন্ডার-ইনভয়েসিং এর অভিযোগ পাওয়া গেছে। 'সবাই ফেয়ার প্রাইস দেখায় না। আবার কখনো কখনো যত ধরণের নথি কিংবা তথ্য দিতে হয়, ইচ্ছাকৃত কিংবা জানার ঘাটতির কারণে আমদানিকারক, ব্যাংক বা সিএন্ডএফ এজেন্ট তা দেন না'।
এনবিআরের সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে ASYCUDA নামক একটি সফটওয়্যারে সংরক্ষিত আমদানি মূল্যের ওপর ভিত্তি করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে কাস্টমস বিভাগ। আগের তিন মাসে সমজাতীয় পণ্য যে দরে শুল্কায়ন করা হয়েছে, তার গড় মূল্যের ওপর ভিত্তি করে একই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
এবিষয়ে এমসিসিআই সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, "বর্তমান বাস্তবতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পণ্যের বিনিময় মূল্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ডেটাবেজ মূল্য বা রেকর্ড মূল্যকে শুল্কায়নের মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়'।
তিনি বলেন, 'কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দর নিয়মিত ওঠানামা করে। যেকারণে হিসটোরিক্যাল ভ্যালুর সাথে এখনকার ভ্যালু মিলবে না'।
ডেমারেজ বাড়ায় প্রতিযোগী সক্ষমতায় পতন হচ্ছে
কাস্টমস যে মূল্যে শুল্কায়ন করতে চায়, আমদানিকারক তা অতিরিক্ত মনে করে মানতে না চাইলে, বন্দরে পণ্য আটকে থাকার ডেমারেজ দিতে হয়, এতে ব্যবসার পরিচালনার ব্যয় বাড়ে।
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'সম্প্রতি একজন আমদানিকারককে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে ৭০ লাখ টাকা পোর্ট ডেমারেজ গুনতে হয়েছে। এর কিছুদিন আগে আরেকজনকে দিতে হয়েছে ৬০ লাখ টাকা'।
তিনি বলেন, 'এতে খুব বেশি ট্যাক্স আদায় হয় না। কিন্তু এর ফলে দীর্ঘ সময়, বাড়তি ব্যয় হচ্ছে –যার কারণে ইন্ডাস্ট্রি সাফার করছে'।
'যদি ব্যবসার পরিবেশকে প্রতিযোগিতা সক্ষম, স্বচ্ছ, হয়রানিমুক্ত ও ব্যবসা বান্ধব করতে হয় – তাহলে লেনদেনের মূল্য অনুযায়ী শুল্কায়ন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিবিরুদ্ধ' – বলেন তিনি।
বড় ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের আশঙ্কা
টিবিএসের সাথে আলাপকালে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও প্যাকেজিংসহ দেশের শীর্ষ শিল্পগুলোর ব্যবসায়ীরা নাম না প্রকাশের শর্তে, বাড়তি মূল্যে শুল্কায়ন কীভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তার ব্যাখ্যা দেন।
তাদের প্রধান উদ্বেগই ছিল ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে। কারণ, আমদানি পণ্য শুল্কায়নে বাড়তি মূল্য ধরলে উচ্চ কাস্টমস শুল্ক ও কর দিতে হয়। এতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে তা ভোক্তার ওপর চাপাতে হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
একইসঙ্গে, এতে কোম্পানিগুলোর জন্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করাও কঠিন হয়ে পড়ে, এতে দেশের সার্বিক প্রতিযোগী সক্ষমতার পতন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
তাদের আরো আশঙ্কা, বাড়তি শুল্কায়নের বাণিজ্যে বাধা তৈরির ঝুঁকি রয়েছে, এতে আন্তর্জাতিক পণ্য ও সেবার প্রবাহ ব্যাহত হয়ে- বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনতিও হতে পারে।
তাদের মতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো একারণে বিনিয়োগ ও জনবল নিয়োগ কমাবে, ভোক্তারাও ব্যয় কমাতে বাধ্য হবেন। এতে অর্থনীতি মন্থর হওয়ার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য প্রভাবই পড়বে।
সমাধানের উপায়
তবে এই সংকট সমাধানের কিছু উপায়ও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অটোমেশন, ভ্যালুয়েশন মডিউল, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সমন্বয়, সরবরাহ চক্র তদারকি আর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, 'উন্নত দেশগুলো ভ্যালুয়েশন মডিউল অনুসরণ করে, যাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থায়, আমদানিকারকের অতীত রেকর্ডের ভিত্তিতে প্রোফাইলিং করে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে তা ASYCUDA এর তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণ করতে হবে।"
মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারের হালনাগাদ তথ্যের ডেটাবেজ সাবস্ক্রাইবের মাধ্যমে অটোমেশন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করে হালনাগাদ প্রকৃত আমদানি মূল্য জানা সম্ভব'।
এনবিআর কর্মকর্তা মাসুদ সাদিক জানান, বিশ্ববাজারের হালনাগাদ দর তথ্য জানতে আলিবাবা ডটকম ও রয়টার্সের মতো সাইটগুলো সাবস্ক্রাইব করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
দেশের ছয়টি কাস্টমস হাউজে দিনে ৮ হাজার বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়া হয়। এরমধ্যে প্রায় ৬ হাজারই হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফরিদ উদ্দিন বলেন, '১০ শতাংশেরও কম আমদানি চালানে আমদানি মূল্য মিথ্যা-ঘোষণার ঝুঁকি থাকে। কোন কোন আমদানিকারক একাজ করছে, আরা কারা করে না এনবিআরকে তার একটা রিস্ক এনালাইসিস করতে হবে। তারা যে দামে আমদানি করেছে, বা তার বিক্রি মূল্য কত – বিশ্ববাজারের হালনাগাদ দরতথ্য দেখেই সঠিক মূল্য জানা সম্ভব'।