শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা
এ যেন মুরগির খোঁয়াড় পাহারার জন্য শেয়ালকে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা।
ইউনিভার্সাল ফিন্যান্সিয়াল সলিউশন্স লিমিটেড (ইউএফএসএল) নামক একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেই চারটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগকারীদের ২৩৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং তারপর নিয়ন্ত্রকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন দুবাইয়ে। এমনটাই জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-র এক প্রতিবেদন সূত্রে।
বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখে ধুলো দিতে সেই আদ্যিকালের পুরোনো ব্যাংকের কাগজপত্র জাল করারই কৌশল নেন ইউএফএসএল- এর এমডি সৈয়দ হামজা আলমগীর, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষগুলো যা শনাক্তই করতে পারেনি। এমনই এক গুরুতর ঘটনায় তিনি আট লাখ টাকার চারটি ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) করেন। এরপর ব্যাংকের নথিগুলোয় কারসাজি করে আমানতের অঙ্ক দেখিয়েছেন ৪৯ কোটি। গত বছরের অক্টোবরে তিনি দেশ ছেড়ে চলেও গেছেন।
ইউএফএসএল যে চারটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে আত্মসাৎ করেছে সেগুলো হলো: ইউএফএস-ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস-আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট, ইউএফএস-পদ্মা লাইফ ইসলামিক ইউনিট ফান্ড এবং ইউএফএস-পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, যার প্রাথমিক তহবিলের আকার ৪৩০ কোটি টাকা।
এই বছরের জানুয়ারিতে ইউএফএসএলে ১৫৮ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে একটি সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিএসইসির কাছে ব্যাখ্যাও চান হাইকোর্ট।
এরপর পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি তদন্ত শুরু করে। অনুসন্ধানে উঠে আসে যে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে যা জানা গিয়েছিল – হামজা আলমগীর তার চেয়েও আরো অনেক বেশি তহবিল – সঠিকভাবে বললে, ২৩৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
বিএসইসি'র প্রতিবেদনে প্রকাশ, এরমধ্যে ১৭০ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
তহবিল চুরিতে নানান কৌশলের আশ্রয় নিতেন হামজা আলমগীর। এরমধ্যে অন্যতম ছিল, তার বা তার আত্মীয়দের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর এবং অত্যধিক ব্যবস্থাপক ফি আদায় – যা সাধারণত ১০-১৫ কোটি টাকা হওয়ার কথা থাকলেও তিনি প্রায় ২০০ কোটি টাকা চার্জ করেছেন।
এরপরও নিজের বিনিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি নাকি অডিটর, ট্রাস্টি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর তত্ত্বাবধায়কদের সন্তুষ্টই রাখতে পেরেছিলেন – যারা নাকি তার জাল এফডিআর- এর ওপর ভরসা করে ধরে নিয়েছিলেন সবকিছু ঠিকই আছে।
২০১০ সালে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসাবে লাইসেন্স পায় ইউএফএসএল। প্রতিষ্ঠানটি ৪৩০ কোটি টাকার সাতটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনা করত।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত অডিট ফার্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএসইসি; এবং ইউনিভার্সাল ফিন্যান্সিয়াল সলিউশন্সের অধীন মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোয় তাদের নিরীক্ষা কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করেছে।
ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), চারটি মিউচুয়াল ফান্ডের ট্রাস্টি এবং তত্ত্বাবধায়ক – ইউএফএসএলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে।
এরমধ্যে একটি মামলা অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়েছে।
আইসিবি এসব ফান্ডে ৪৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল, যা উদ্ধার এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়লো।
পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও বিএম ইউসুফ আলী বলেন, বিমা কোম্পানিগুলোকে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের নির্দেশ দেয় বিএসইসি। এরপর তারা ইউএফএস-পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ডে প্রায় ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন।
প্রথম দুই বছরে তারা সময়মতো লভ্যাংশও পেয়েছেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, তহবিলটি আত্মসাতের ঘটনায় এখন অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে পপুলার লাইফ। "টাকা ফেরত না পেলে আমরা আর্থিক সংকটে পড়ব। এ বিষয়ে বিএসইসি কী ব্যবস্থা নেয় আমরা তা দেখার অপেক্ষা করছি।"
৫৯ কোটি টাকার ভুয়া বিনিয়োগ
এদিকে, বিএসইসি'র তদন্তে ইউএফএসএলের বিনিয়োগের কাগজপত্রেও জালিয়াতি পাওয়া গেছে। যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফান্ডগুলো থেকে করা হয়েছে বলে দাবি করা হয় সেসব ইউএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তার সহযোগীদের মালিকানাধীন।
ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন্সের তথ্যমতে, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে তারা ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তিনটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রায় ৫৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
তারা ইউএফএস-পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ডের মাধ্যমে ভ্যানগার্ড ট্রেডার্স, তানজিনা ফ্যাশন, আরআই এন্টারপ্রাইজ, নেত্রকোনা এক্সেসরিজ এবং মাল্টিম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল-এ ২৫.১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আরও ২৫ কোটি টাকা ইউএফএস-আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ডের মাধ্যমে নেত্রকোনা এক্সেসরিজ এবং মাল্টিম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল-এ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিনিয়োগের মেয়াদ ছিল চার মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর; যাতে সুদের হার সর্বোচ্চ ১২.৫ শতাংশ। তবে এখনো রিটার্ন আসেনি।
১৭০.৬৯ কোটি টাকা পাচার
বিএসইসি'র তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ইউএফএসএল যে ২৩৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, তারমধ্যে ১৭০.৬৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত অর্থের মধ্যে ৫৮.৯০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বিনিয়োগের নামে বাণিজ্যিক নথিপত্র জাল করার মাধ্যমে। ৪৭.৯২ কোটি টাকা ভুয়া এফডিআরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয় এবং ৬৩ কোটি টাকা নিবন্ধিত সিকিউরিটিজের শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রত্যাহার করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো প্রকাশ, ভুয়া বিনিয়োগ ও ভুয়া এফডিআর থেকে ফান্ডগুলোর সুদপ্রাপ্তি না হওয়া বাবদ লোকসান হয়েছে ৫৮.৬০ কোটি টাকা। উপরন্তু, ফান্ডগুলোর নেট সম্পদ মূল্য (এনএভি) বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে তাদের ট্রাস্টি, কাস্টোডিয়ান ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের থেকে আরো ৫.৮২ কোটি টাকা রিফান্ড নেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত চার্জ হিসেবে।
তদন্তে পাওয়া যায়, ইউএফএসএল প্রতি প্রান্তিকে কমিশন, ট্রাস্টি ও কাস্টোডিয়ানের কাছে অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বছর শেষে ভুয়া ব্যাংক ব্যালেন্স জমা দিয়েছে; কিন্তু নিরীক্ষক সেটা যাচাই করেনি।
তদন্তে জানা গেছে, হামজা আলমগীর প্রাথমিকভাবে চারটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ইউএফএসএলের ব্যাংক হিসাবে টাকা স্থানান্তর করেন। এরপরে তিনি নিজের সহযোগী এবং তাদের কোম্পানিতে কিছু তহবিল স্থানান্তর করার সময় স্থানান্তরিত অর্থের বড় অংশ প্রত্যাহার করে নেন।
তহবিল পাচারের জন্য ভ্যানগার্ড ট্রেডার্স, তানজিনা ফ্যাশন, আরআই এন্টারপ্রাইজ, নেত্রকোনা এক্সেসরিজ, মাল্টিম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল, স্কেপটার কমোডিটিস, নিটওয়্যার ক্রিয়েটর, ম্যাক্স সিকিউর এবং মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকীর ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করছে তদন্ত কমিটি।
বিশেষ নিরীক্ষার পরামর্শ
ইউএফএসএল কী পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করেছে বা সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয় থেকে কী পরিমাণ নেট লাভ প্রত্যাহার করেছে– তা নির্ধারণ করতে পারেনি তদন্ত কমিটি, যার কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে এক বিশেষ নিরীক্ষা (স্পেশাল অডিট) করার পরামর্শ দিয়েছে ।
পর্যবেক্ষণে তদন্ত কমিটি বলেছে, "এই ধরনের তহবিল স্থানান্তর স্পষ্টতই একটি কারসাজির পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থপাচারের কার্যকলাপ। অতএব, আত্মসাৎকৃত তহবিলের সুবিধাভোগীদের শনাক্ত করতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের অধীনে আরও তদন্ত করা যেতে পারে।"
ইউএফএসএল অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকে মোট ২২৩.৫৬ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে এর ব্যালান্স ছিল ৪,১৭৮ টাকা মাত্র। এসময়ে এর ইকুইটি মূলধন ছিল মাত্র ১১.১৮ কোটি টাকা।
আইসিবি'র পদক্ষেপ
আইসিবির কর্মকর্তারা জানান, ফান্ড আত্মসাতের বিষয়ে তারা শুরুতে কিছুই আঁচ করতে পারেনি। যখন পেরেছেন, তখন ইতোমধ্যে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়ে গেছে।
অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিটির সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশনা দেয় আইসিবি। এরপর দুটি মামলা করে।
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেনের সাড়া পায়নি টিবিএস। তার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
তবে এর আগে আবুল হোসেন টিবিএসকে বলেছিলেন, ইউএফএসএল- এর এমডি হামজা আলমগীর ইমেইলে যোগাযোগ করছেন, তিনি টাকা ফেরত দিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
বিএসইসি'র বিবৃতি
বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম টিবিএসকে বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, "বিনিয়োগকারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় কমিশন তা নিশ্চিত করবে।"
কমিশন এখন কী করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী মামলা করা যাবে। "কাস্টোডিয়ান এবং ট্রাস্টিরও এখানে দায়িত্ব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি সংস্থাও চাইলে বিষয়টি তদন্ত করতে পারে," যোগ করেন তিনি।