উচ্চ সুদ ব্যয় মেটাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর তাগিদ অর্থনীতিবিদদের
মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে দেশে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণ না বাড়লেও ভবিষ্যতে সুদ পরিশোধের ব্যয় বাড়বে। এ অবস্থায় অত্যাবশ্যক খাতগুলোর ব্যয় মেটাতে কর আহরণ বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে না পারলে সরকারের পক্ষে ঋণ পরিশোধের ব্যয় মিটিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোর ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস)-এর আয়োজনে 'ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট: হোয়ের ইজ বাংলাদেশ হেডেড?' শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কানাডার কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস প্রফেসর ও ভিজিটিং প্রফেসরিয়াল ফেলো ড. সৈয়দ মাইনুল আহসান। এ সময় তিনি বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসেবে সরকারি ঋণের নিরাপদ কোনো মাত্রা নেই। শ্রীলঙ্কার মত ইতালিতেও ডেট-জিডিপি রেশিও প্রায় ১০০।
"ওইসিডি দেশগুলোতে এই হার আরও বেশি। আর জাপানে জিডিপির দ্বিগুণের বেশি সরকারি ঋণ। এক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারের আয় বাড়ছে কি-না সেটিই বিবেচ্য বিষয়," বলেন তিনি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, "বর্তমানে মোট রাজস্ব আদায়ের প্রায় ১৮ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। জিডিপির তুলনায় আমাদের ঋণের পরিমাণ কিছুটা বাড়তির দিকে থাকলেও রাজস্ব আয় বাড়ছে না। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে তা উল্টো কমে এসেছে। এটা বাড়ানো না গেলে ভবিষ্যতে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।"
সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর প্রশাসনে সংস্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে অটোমাইজেশান নিশ্চিত করা ও করের আওতা বৃদ্ধিতে ডিসেন্ট্রালাইজেশানের তাগিদ দেন তিনি।
এছাড়া, আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতির আকার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের অনেক হিসাবই সঠিক অবস্থায় নেই। আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমির কথা বলা হলেও এর আকার সম্পর্কে কোনো ধরাণা নেই। তাছাড়া, কোনো হিসাব ব্যবস্থায়ই সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসাবে আসে না।"
ব্ল্যাক ইকোনমি বা আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি সব দেশেই রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, "কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে লেনদেন গোপন করা হয়। তবে অধিকাংশ দেশেই আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমির পরিমাপ করা হয়ে থাকে।"
"বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে কালো অর্থনীতির পরিমিতি, তাদের কার্যক্রমের পরিধি, এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করা যায়, কীভাবে এটাকে সাদা অর্থনীতিতে আনা যায়- সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া," যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
এ সময় তিনি আরও বলেন, বিদেশি ঋণে সুদের হার আগে অনেক কম থাকলেও এখন তা বাড়ছে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ ঋণে সুদ বাবদ যে ব্যয় বেশি হচ্ছে, তা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও উল্লেখ করেছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় কমাতে সংস্কার নিশ্চিত করতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও তেমন সুফল আসছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গ্লাসগোর স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মোজাম্মেল হক আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, সরকারি ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুতর ধরনের কোনো উদ্বেগের মধ্যে নেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা সংকট দেখা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার সংকটের পরে পাকিস্তানেও সংকট আসছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশেও কিছু বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা নিয়েও অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন ড. আহসান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি, যা আর্থিক ব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই ভালো নয়।
এ সময় তিনি বলেন, "বাংলাদেশে কখনই কোনো ব্যাংককে ফেইল করতে দেওয়া হয় না। এটা একটা খারাপ কালচার। ব্যবসা করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ফেইল করানো উচিত।" তবে এর আগে আমানতের ইন্স্যুরেন্স করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকের ক্যাপিটালাইজেশান বন্ধ করতে হবে। বিষয়টিকে সুশাসনের ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, "ব্যাংকের সংখ্যা কমানো না হলে গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।"
সভাপতির বক্তব্যে বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা টেকসই। তবে কোভিডের চাইতে এই খাত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হলে দেশ নাজুক অবস্থায় পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৪০ শতাংশের দিকে তাকিয়ে থেকে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। আয়ের কত অংশ ঋণ আর সুদ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে সেটিও দেখতে হবে।"
"সুদ পরিশোধে আমাদের রাজস্বের ১৮ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। এটা যত বাড়বে অন্য খাতে আর্থিক ক্ষমতা তত কমবে। এই পরিমাণটা এখনও অস্বাভাবিক বেশি নয়। তারপরেও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে," মন্তব্য করেন তিনি।
সরকার ঠিক সময়ে আইএমএফ-এর ঋণের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেন বিনায়েক সেন। সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের জন্য ভালো হবে বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।