রাজশাহীর বিসিক শিল্পনগরী: বেআইনিভাবে বন্ধ কারখানা ভাড়া দিয়ে লাভ করছেন মালিকরা
একসময় খুবই রমরমা ব্যবসা ছিল রাজশাহীর সপুরায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প- বিসিক নগরীতে ১৪,৪৫১ বর্গফুট জায়গার ওপর স্থাপিত মেসার্স হক রাইস মিলের। এই মিল থেকে উত্তরবঙ্গে চাল সরবরাহ করা হতো। বড় আকারের ঋণ থাকায় ২০১৭ সালে মিলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন মালিকপক্ষ। তারপর থেকে বন্ধই রয়েছে মিলটি।
তবে মিল বন্ধ থাকলেও মালিকপক্ষ জায়গাটি বিসিকের কাছে ছেড়ে দেননি। বরং মিলটির একপাশে ২৫টি ছোট ছোট রুম তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন লোকজনের কাছে। মিলটির ফ্লোর ভাড়া নিয়ে দুইটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ব্যবসাও করছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুরুতে বিসিক শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ নিয়ে কারখানা করে উৎপাদনে গেলেও অনেক কর্তৃপক্ষই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ রেখেছেন। অনেকে আবার অবৈধভাবে অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়েছেন।
বিসিকে ভাড়া নিয়ে অবৈধভাবে মানুষজন যেমন থাকছেন, তেমনি ভাড়া দেওয়া হয়েছে লন্ড্রির দোকান, ফার্নিচার, কাঠ চেরাই মিল ও মসলার দোকান। অনেকে ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করেও ব্যবসা করছেন। তবে যেসব প্লটের মালিক এসব অবৈধ কাজের সাথে যুক্ত তাদের কারখানার সামনে কোনো সাইনবোর্ড নেই। ফলে সেইসব কারখানা খুঁজে পাওয়াও কঠিন।
রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরীর শিল্পকর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিম বলেন, "এখানে প্রতি বর্গফুটে মাত্র সাড়ে ৩ টাকা সার্ভিস চার্জ হলেও অনেকেই সার্ভিস চার্জ ঠিকমতো দেন না। বিশেষ করে যাদের কারখানা বন্ধ তারা কোনো সার্ভিস চার্জ দেননা। কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো সার্ভিস চার্জ বকেয়া পড়ে রয়েছে।"
বিসিকের তথ্যমতে, সপুরায় অবস্থিত বিসিকে ২০০টি কারখানার মধ্যে ১৫টি বন্ধ পড়ে রয়েছে। তারা একসময় উৎপাদন করলেও এখন বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ রেখে সেইসব জমি অন্যের কাছে অবৈধভাবে ভাড়া দিয়েছে।
তবে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কমপক্ষে ৫০টি প্লটের মালিক কারখানা তৈরি করে তা বন্ধ রেখেছেন কিংবা অন্যদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন, যার তথ্য বিসিকের কাছে পাওয়া যায়নি।
মিলটিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাসরত উজ্জ্বল নামের একজন জানান, তিনি মাসিক ৩০০০ হাজার টাকা ভাড়া নিয়ে এখানে থাকেন। অন্যান্য জায়গার তুলনার কম ভাড়া হওয়ায় এখানে থাকেন বলে জানান তিনি।
রাইস মিলটিতে উজ্জ্বলের মতো প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার ভাড়া থাকেন। মিলটির পেছনের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে টানা প্রায় ২৫টি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে শতাধিক লোকজন ভাড়া থাকেন। বাসা ভাড়া থেকেই মালিকের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ভাড়া আসে।
এছাড়া মাসিক ১৩ হাজার টাকায় রাইস মিলটির চাতাল ভাড়া নিয়ে একবছর ধরে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ভাঙ্গা জিনিসপত্র প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবসা করছেন মো. সুমন নামের একজন। এছাড়া আব্দুল ওয়াদুদ হাজী নামের একজন দুটি গুদাম ভাড়া নিয়ে পাটের বস্তার কারখানা স্থাপন করে ব্যবসা করছেন। তিনি চার বছর ধরে মাসিক ৭০০০ টাকা ভাড়াতে জায়গাটি নিয়েছেন।
মেসার্স হক রাইস মিলের ম্যানেজার তরুণ কুমার জানান, "ক্লাসিফায়েডের কারণে ২০১৭ সাল থেকে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। এবি ব্যাংক প্রায় ২৫ কোটি টাকার মতো মিলটির মালিকদের কাছ থেকে পাবে। এ বিষয়ে আদালতে একটি মামলা চলমান আছে।"
তিনি জানান, মালিক পক্ষ জায়গাটি বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভালো কাস্টমার না পাওয়ায় তারা বিক্রি করতে পারছেন না। মালিকপক্ষ জায়গাটির ৩০ কোটি টাকা দাম চায়।
বিসিকের তথ্যমতে, রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরী-১ এর জমির পরিমাণ ৯৬ একর বা ৪১,৮১,৭৫৯.৫৬ বর্গফুট। এরমধ্যে মেসার্স কেরামত রাইস ও আটা মিল ১৮,৬০৪ বর্গফুটের প্লট নিয়ে থাকলেও সেখান থেকে উৎপাদন না করে অবৈধভাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। চাতাল ভাড়া দেওয়া হয়েছে বিসমিল্লাহ প্লাস্টিক কারখানাকে এবং একটি তেলের কারখানাকে। এছাড়া রাইস মিল কর্তপক্ষ সেখানে দোতলা বাড়ি তৈরি করে বসবাসও করছেন।
এছাড়া সরেজমিনে দেখা যায়, বিসিকে মেসার্স বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের দুটি প্লট থাকলেও একটিতে তাদের কারখানা রয়েছে। অন্য প্লটটি কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে রয়েছে একটি ফার্নিচারের শো-রুম, একটি মসলার দোকান, একটি কাঠ চেরাই মিল ও একটি ঝুট কাপড়ের গুদামঘর। যার তথ্য বিসিকের কাছে নেই।
বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ভাড়া নেওয়া ফার্নিচার ব্যবসায়ী মুনজুর রহমান জানান, তিনি বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে তিন মাস ধরে মাসিক ১০ হাজার টাকাতে এই ঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন।
সেখানেই গুদামঘর ভাড়া নিয়েছেন মেসার্স বিএম এন্টারপ্রাইজ। পুরাতন কাপড়ের ব্যবসা করা বিএম এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার তুহিন আলী জানান, তারা ৯ বছর ধরে এই গুদামঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। তবে কত টাকা ভাড়া দেওয়া হয় তা তিনি জানাননি।
বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোপাইটার ফয়সল বিন মাহবুব জানান, তাদের এই প্লটটিতে অন্য ব্যবসা করার চিন্তাভাবনা ছিলো। কিন্তু ব্যবসার ধীরগতির কারণে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। এইজন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, মেসার্স নূর হাবিব গ্রেইন ইন্ডাস্ট্রিজ (৭৮,৫০০ বর্গফুট) গত কয়েকবছর ধরে বন্ধ। তাদের দুটি গুদামের একটি ৫০ হাজার, আরেকটি ১৫ হাজার টাকাতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্লটে তাদের ফ্লাওয়ার মিল আছে, সেটাও তারা ভাড়া দিতে চায়।
মেসার্স নূর হাবিব গ্রেইন ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোপাইটার আলহাজ্জ্ব ফারুক শাহ্ জানান, "কাস্টমারদেরকে প্রচুর পরিমাণে বাকিতে পণ্য দেওয়ার পর তা আর রিকভারি করা সম্ভব হয়নি। আমরা যেহেতু চাইনি লোন করে বিজনেসটা কন্টিনিউ করতে, তাই ফ্লাওয়ার মিলও ভাড়া দেওয়া হবে। এছাড়া গ্রেইন ইন্ডাস্ট্রিজের দুইটি গুদাম ও চাতাল ভাড়া দেওয়া আছে।"
রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরীর শিল্পকর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিম জানান, "বিসিকে আমাদেরকে না জানিয়ে অনেকেই অবৈধভাবে তাদের প্লট অন্যের কাছে ভাড়া দিয়েছে। আমরা সেগুলোর তালিকা তৈরি করছি। এছাড়া বেশ কয়েকটি বন্ধ থাকা প্লট হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে। সেজন্য বন্ধ তালিকায় সেসব নাম দেওয়া হয়নি।"
"১০টা পরিবার নিজের প্লটে বাড়ি তৈরি করে অবৈধভাবে বসবাস করতো। তাদের মধ্যে কয়েকটা পরিবারকে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখনো কয়েকটা পরিবার বসবাস করছেন তাদেও ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেও জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বলা আছে। জেলা প্রশাসক তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন," যোগ করেন তিনি।
আনোয়ারুল আজিম আরো বলেন, "অনেক উদ্যোক্তা আছেন যারা প্লট চান কিন্তু আমরা তাদের প্লট দিতে পারিনা। অথচ অনেকেই প্লট বন্ধ রেখে ভাড়া দিয়ে রাখছেন।"
এজি প্লাস্টিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোপাইটার আব্দুল গণি জানান, "আমাদের কারখানা যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তাতে আরো একটি প্লট পেলে আমার ব্যবসা করা সুবিধা হতো। কিন্তু প্লট না পাওয়ায় কষ্ট করেই ব্যবসা করতে হচ্ছে।"
বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মালেক জানান, বিসিকের অনুমোদন নিয়ে প্লট ভাড়া দিতে গেলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। আর স্থানীয় অফিসও এই অনুমোদন দিতে পারে না। ঢাকা অফিস থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এমনকি প্লট ভাড়া দেওয়ার অনেক আবেদন ঢাকায় পড়ে আছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, "বিসিক আমাদের কোনো সেবা দেয় না। অথচ ৯০ সাল পর্যন্ত এক একরে আমারে সার্ভিস চার্জ দিতাম ৫০০ টাকা। এখন সেখানে প্রতি একরে প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয় বছরে। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে কারখানাতেই বাসা করে থাকে।"