সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোকে ঝুঁকির বিপরীতে ৪০%-১০০% রিজার্ভ রাখতে হবে: আইডিআরএ
বীমা কভারেজের ঝুঁকির বিপরীতে সলভেন্সি মার্জিন হিসেবে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স বা সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোকে ৪০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত রিজার্ভ রাখতে হবে বলে জানিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)। বীমা খাতের ঝুঁকি বহনের ক্ষমতা বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এই প্রথম সলভেন্সি মার্জিন রেগুলেশনস জারি করতে যাচ্ছে।
এরজন্য আইডিআরএ একটি খসড়া নীতিমালাও প্রস্তাব করেছে। সেখানে বীমা পলিসির ইন্স্যুরেন্স কভারেজ বা ঝুঁকির বিপরীতে রিজার্ভ রাখার জন্য বলা হয়েছে।
সলভেন্সি মার্জিন হল বীমাকারীর সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত দায়ের বিপরীতে একটি ন্যূনতম মূল্য। এটি অনেকটা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি বা মূলধন পর্যাপ্ততার প্রয়োজনীয়তার মতো।
মূলত বাংলাদেশে বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর আর্থিক ভিত খুবই দূর্বল। এরজন্য কোনো কোম্পানিই যথাসময় বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারে না। এতে বীমা খাতের প্রতি জনসাধারণের আস্থার সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই প্রবিধানমালা তৈরি করেছে। এতে বীমা কোম্পানির ঝুঁকিগ্রহণে আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে।
জাতীয় বীমা নীতিতেও সলভেন্সি মার্জিন প্রবিধানমালা জারি করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত খসড়া প্রবিধানটি ৬ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে তোলা হয়। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে খসড়া প্রবিধানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামত দিতে বলা হয়েছে।
প্রবিধানমালার খসড়া অনুযায়ী, জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোকে খাতভিত্তিক বিভিন্ন বীমা পলিসিতে ঝুঁকি কভারেজের ওপর নির্ধারিত শতাংশ হারে রিজার্ভ রাখতে হবে।
আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহম্মদ জয়নুল বারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সারা পৃথিবীতে এই ধরনের আইন রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে এতদিন এটি ছিল না। আমরা বীমা খাতের সাস্টেইনিবিলিটি নিশ্চিতের লক্ষ্যেই আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছি।"
তিনি বলেন, মূলত, বীমা কোম্পানি যেন তাদের ঝুঁকির বিপরীতে সহজে বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারে, সেজন্যই এ আইন।
"কারণ বীমা কোম্পানির সলভেন্সি না থাকলে বীমার দাবি পরিশোধ করতে পারবে না। বর্তমানে বীমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা দেখতে পাচ্ছি, যার জন্যই এই আইন করা হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "নন-লাইন বীমা কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে সলভেন্সি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই আইন হলে আমরা সার্বক্ষণিক বীমা কোম্পানির ব্যবসা মনিটর করতে পারবো যে, কোম্পানিটি তার সক্ষমতার বাইরে ঝুঁকি নিচ্ছে কিনা।"
আইনটি এখন খসড়া পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, যেসব বীমা কোম্পানি রিজার্ভ নিশ্চিত করতে পারবে না, তাদেরকে সময় দেওয়া হবে।
কতদিন সময় দেওয়া হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে গেজেট প্রকাশের সময় অবশ্যই চূড়ান্ত করা হবে।"
দেশে বীমা ব্যবসার প্রচলন স্বাধীনতার পরপর শুরু হলেও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক ভিত শক্ত করার জন্য সলভেন্সি মার্জিন নীতিমালা গ্রহণ করা হয়নি। যদিও পার্শ্ববর্তী ভারতে ২০০০ সালেই এ নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে।
যেভাবে রিজার্ভ রাখতে হবে
খসড়া রেজুলেশনে বলা হয়েছে, গৃহীত ঝুঁকির বিপরীতে অগ্নি বীমা পলিসিতে ৪০ শতাংশ, সামুদ্রিক বীমায় ৫০ শতাংশ, মেরিন-হল বীমায় শতভাগ, মোটর বীমায় ৪০ শতাংশ, এভিয়েশন বীমায় শতভাগ, স্বাস্থ্য বীমায় শতভাগ এবং অন্যান্য বীমা পলিসির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ রিজার্ভ রাখতে হবে।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, কোনো সাধারণ বীমা কোম্পানি যদি অগ্নি বীমা পলিসির মাধ্যমে কোনো গ্রাহকের এক কোটি টাকার ঝুঁকি গ্রহণ করে, তাহলে সলভেন্সি মার্জিন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে ওই ঝুঁকির ৪০ শতাংশ রিজার্ভ রাখতে হবে।
সেক্ষেত্রে কোম্পানিটিকে তার প্রফিট বা লাভ থেকে এই রিজার্ভ করতে হবে। প্রফিট থেকে সম্পূর্ণটা রাখা সম্ভব না হলে ফ্রেশ ক্যাপিটাল ইনজেক্ট করে রিজার্ভ বাড়াতে হবে।
সূত্র জানায়, সলভেন্সি মার্জিন প্রবিধানমালা কার্যকর হলে যাদের রিজার্ভ কম, তারা বড় পলিসি বিক্রি করতে পারবে না।
এছাড়া, বীমা কোম্পানির অপরিশোধিত দাবির বিপরীতে শতভাগ রিজার্ভ রাখতে হবে। পাশাপাশি খারাপ ও সন্দেহজনক ঋণ, প্রস্তাবিত লভ্যাংশ, কর, অপ্রত্যাশিত ক্ষতি এবং সুদের রিজার্ভসহ ব্যাংক ঋণের বিপরীতে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে বলে প্রস্তাবিত প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে।
এরসঙ্গে, যেসব সম্পদের মূল্য হিসাব করা যাবে না, অর্থাৎ শূন্য মূল্য ধরতে হবে, তার একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে খসড়া প্রবিধানমালায়।
খসড়া প্রবিধানমালায়, কোম্পানিগুলোকে হিসাব দেওয়ার জন্য তিনটি ছক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই নির্ধারিত ছকেই কোম্পানিগুলো বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
বীমা দিবসে এক সংবাদ সম্মেলনে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, "বীমা খাতের দাবি নিষ্পত্তির হার ৩০ শতাংশের বেশি। তবে যদি চার থেকে পাঁচটি কোম্পানি বাদ দেওয়া হয়, তবে এই হার প্রায় ৯০ শতাংশ।"
দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতকেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশে বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৮১টি। এর মধ্যে ৩৫টি জীবন বীমা কোম্পানি এবং ৪৬টি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স বা সাধারণ বীমা কোম্পানি।
আইডিআরএ'র পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের শেষে বীমাখাতে গ্রস প্রিমিয়ামের পরিমাণ ছিল ১৬,৮১২.৬৫ কোটি টাকা। কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আগের বছরের তুলনায় এই প্রিমিয়াম প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি।
জীবন বীমার গ্রস প্রিমিয়াম ছিল ১১,৩৯৯.৫১ কোটি টাকা এবং নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স বা সাধারণ বীমার গ্রস প্রিমিয়াম ছিল ৫,৪১৩.১৪ কোটি টাকা।
এছাড়া, ২০২১ সালে মোট বীমা দাবির সংখ্যা ছিল ৩০,৬২,৪৬৮টি। এরমধ্যে ১৮,৯২,৯৯২টি জীবন বীমা এবং ১৯,৮৭৭টি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বীমা কোম্পানি মোট ১৯,১২,৮৬৯টি দাবি নিষ্পত্তি করেছে। এছাড়া, নিষ্পত্ততিহীন মোট দাবির পরিমাণ ৬,৫৫৯.৮১ কোটি টাকা।