পর পর দুই মাসে রপ্তানিতে ধস
এপ্রিলে টানা দ্বিতীয় মাসের ন্যায় বাংলাদেশের পণ্যদ্রব্য রপ্তানি কমেছে, এতে আরো চাপের মধ্যে পড়ল চলমান ডলার সংকটে থাকা দেশের অর্থনীতি। রপ্তানিতে এমন সময়েই পতন এলো- যখন আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে, পড়তি রিজার্ভকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সরকারও হিমশিম খাচ্ছে।
মার্চে ২.৪৯ শতাংশ কমার পর- এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে ১৬.৫২ শতাংশ।
তৈরি পোশাক (আরএমজি), চামড়া, হোম টেক্সটাইলস ও পাটপণ্যসহ দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাতগুলোর প্রধান প্রধান বাজারে চাহিদা কমেছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাবই এর অন্যতম একটি কারণ বলে জানান রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র হালনাগাদ তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে রপ্তানি খাত আয় করেছে ৩.৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই মাসে ছিল ৪.৭৩ বিলিয়ন ডলার।
গবেষণা সংস্থা- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'ডলার সংকট এখনও কাটিয়ে না ওঠায় এটা অবশ্যই মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির ওপরও চাপ সৃষ্টি করবে। পর পর দুই মাস রপ্তানিতে পতন উদ্বেগের বিষয়'।
বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহও এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে স্বীকার করেন তিনি।
তবে আহসান এইচ মনসুর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, শরতকালীন রপ্তানি কার্যাদেশ আসা শুরু করলে রপ্তানি ইতিবাচক ধারাবাহিকতায় ফিরবে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সামগ্রিক রপ্তানি বার্ষিক ৫.৩৮ শতাংশ বেড়ে ৪৫.৬৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
এপ্রিলে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত - পোশাক খাতের রপ্তানি আয় ছিল ৩.৩২ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের তুলনায় যা ১৫.৪৮ শতাংশের মতোন উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়েছে।
এর মধ্যে বছরওয়ারি হিসাবে, উভেন পণ্য চালানে ১৭.৪৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়ে রপ্তানি হয়েছে ১.৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য; নিট পোশাক রপ্তানিও ১৩.৭৮ শতাংশ কমে হয়েছে ১.৮৩ বিলিয়ন ডলারের।
হিমায়িত ও জ্যান্ত মাছ, কৃষিপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটপণ্য এবং হোম টেক্সটাইলের মতোন অন্যান্য প্রধান রপ্তানি খাতও এপ্রিলে ভালো পারফর্ম করেনি।
এসব রপ্তানি পতনের মিলিত প্রভাব- চলতি অর্থবছরের ইতিবাচক ধারাবাহিকতা থেকে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে সার্বিক রপ্তানি পতনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পোশাক রপ্তানি ৯ শতাংশ বেড়ে ৩৮.৫৭ বিলিয়ন ডলারের হয়েছে। এর মধ্যে ২০.৯৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে নিটওয়্যার রপ্তানি থেকে, যা বার্ষিক ৮.৯৭ শতাংশ বেড়েছে। উভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় ৯.২৪ শতাংশ বেড়ে ১৭.৬০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিশ্ববাজারে চাহিদা কম থাকায় প্রায় প্রতিটি কারখানাকে লো ক্যাপাসিটিতে চলতে হচ্ছে। এছাড়া, রমজান ও ঈদুল ফিতরের মাস হওয়ায়, গত মাসে পোশাক শিল্পে প্রায় ১২ দিন ছুটি ছিল। রপ্তানি আয়ের তথ্যে এসবের প্রতিফলন দেখা গেছে'।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই পোশাক রপ্তানির কার্যাদেশ কমছে। তবে গত দুই মাসের কথা বাদ দিলে, তার আগে কিছু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি এবং অপ্রচলিত বাজারগুলোয় রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে এই ধাক্কা সামাল দেওয়া গিয়েছিল।
গবেষণা সংস্থা- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'ব্যাংকের উচ্চ সুদহার, পশ্চিমা দেশগুলোতে টেকনিক্যাল অর্থনৈতিক মন্দাভাব এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের উচ্চমূল্য– প্রধানত এ তিন কারণে আমাদের পোশাক রপ্তানি কমেছে'।
ড. রাজ্জাক রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এরও চেয়ারম্যান। তিনি আরো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, 'পশ্চিমা দেশগুলো সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে, এতে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে'।
বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ৪৬.৮০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাইলে, আগামী দুই মাসের প্রতিমাসে আমাদের অন্তত ৪.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি করতে হবে।
এপ্রিলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি প্রায় ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ইপিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ খাতের রপ্তানি আয়ও সামান্য কমেছে।
হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে ৫৩.৪ শতাংশের মতোন ব্যাপক ধস হয়েছে, রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৮০ মিলিয়ন ডলারের। আগের অর্থবছরের একই মাসে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৭৩.৫৬ মিলিয়ন ডলার।
টিবিএস এর সঙ্গে আলাপকালে মমটেক্স এক্সপো লিমিটেডের ব্যবসায়িক প্রধান জোসেফ চৌধুরী বলেন, যুদ্ধের কারণে হওয়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে অনেক মানুষই আর হোম টেক্সটাইল কিনছেন না, এতে ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য পতন প্রত্যক্ষ করেছে পাট শিল্পও। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ২০.২৫ শতাংশ কমে যা নেমে এসেছে ৭৭০.৮২ মিলিয়ন ডলারে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৬৬.৫১ মিলিয়ন ডলার।