যৌথ বিনিয়োগে চট্টগ্রাম আইসিডিতে গড়ে উঠছে ওয়্যারহাউজ, রপ্তানিতে সময় ও চুরি কমবে
রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে চট্টগ্রামে বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোগুলোতে (আইসিডি) যৌথ বিনিয়োগে গড়ে উঠছে ওয়্যার হাউজ ব্যবস্থা। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্য পরিবহন সহজ করতে বৃহৎ শিপিং কোম্পানি, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, লজিস্টিকখাতের উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগ করছেন।
সেক্টর ইনসাইডারদের মতে, ডিপোতে গুদাম সুবিধা থাকলে পণ্যের কোয়ালিটি কন্ট্রোলের সময় কমবে, সেইসাথে চুরি বা অন্যান্য সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিও রোধ করা যাবে।
বিশ্বের বৃহৎ শিপিং কোম্পানি মায়ের্কস লাইন ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ইস্পাহানি সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনাল লিমিটেড (আইএসএটিএল) এবং ভার্টেক্স অফ-ডক লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডে তিন লাখ স্কয়ার ফিটের দুটি ওয়্যার হাউজ নির্মাণ করেছে।
আগামী বছরের এপ্রিলে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল) এ আরো দুই লাখ ১০ হাজার স্কয়ার ফিটের ওয়্যার হাউজ চালু হবে। এটি চালু হলে চট্টগ্রামে তিনটি ডিপোতে মায়ের্কস লাইনের ৫ লাখ স্কয়ার ফিটের ওয়্যার হাউজ সুবিধা তৈরি হবে।
সম্প্রতি জারি করা এক বিবৃতিতে মায়ের্কস দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ আগরওয়াল বলেছেন, "আমরা বাংলাদেশে নিজেদের পদচিহ্ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই দেশে আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং জোরদার করছি।"
"আমরা এই দেশ ও এর রপ্তানিকারকদের সম্ভাবনায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং আমরা তাদের নিজ নিজ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা পালনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ," বিকাশ যোগ করেছেন।
সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল) কর্তৃপক্ষের মতে, ইস্পাহানি সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনাল লিমিটেড ৫ বছরের চুক্তির আওতায় চট্টগ্রামের একে খান এলাকায় তাদের ডিপোতে মায়ের্কস এর জন্য ২,০০,০০০ বর্গফুটের একটি গুদাম তৈরি করেছে। এছাড়া পতেঙ্গা এলাকায় সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের দুই লাখ বর্গফুটের আরেকটি গুদাম নির্মাণের কাজ গত রমজানের আগে শুরু হয়েছে।
শুধু মায়ের্কস লাইনই নয় বর্তমানে বিভিন্ন ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানও এই ধারণা নিজে কাজ শুরু করেছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডিপোতে স্পেস ভাড়া নিয়ে পৃথক ওয়্যারহাউজ পরিচালনা করছে।
এর আগে ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি অফডক কেডিএস লজিস্টিকসের সাথে যৌথ বিনিয়োগে অল পোর্ট কার্গো ৭০ হাজার স্কয়ার ফিট আকারের ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করেছিল।
বেসরকারি অফডক কেডিএস লজিস্টিকস এর এডিশনাল জেনারেল ম্যানেজার শিমুল দাশ টিবিএসকে বলেন, "বিশ্বের জায়ান্ট ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাদের জন্য ডিপোর ওয়্যারহাউজে নির্দিষ্ট স্থান থাকে। এরপরও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যৌথ বিনিয়োগে ডিপো মালিকদের সাথে ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করছে। ২০১৬ সালে যৌথ বিনিয়োগে অল পোর্টের সাথে করা আমাদের চুক্তি শেষ হলেও প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম এখনো চালু রয়েছে।"
সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল) পতেঙ্গায় তাদের ডিপোতে এক্সপ্রার ফ্রেইটের জন্য ১ লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার ফিট সহ বেশ কয়েকটি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডদের জন্য প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার স্কয়ার ফিটের ওয়্যারহাউজ তৈরি করেছে।
এসএপিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, "বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো সামিট অ্যালায়েন্স এর সাথে যৌথ বিনিয়োগে ওয়্যারহাউজ করছে, এটি রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এতে সেবার মান আরো উন্নত হচ্ছে।"
চট্টগ্রামের অন্যান্য কনটেইনার ডিপোতেও বিভিন্ন মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও) এবং মায়ের্কস সহ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের জন্য ওয়্যারহাউজের স্থান বরাদ্দ রয়েছে।
নির্দিষ্ট ওয়্যারহাউজের সুবিধা
রপ্তানিকারক, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এবং ডিপো মালিকরা জানিয়েছেন, রপ্তানিযোগ্য পণ্য রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিরা কারখানায় গিয়ে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করে। কোন নির্দিষ্ট ক্রেতার পণ্য একাধিক কারখানায় থাকলে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করতে সময় বেশি লাগে। সব পণ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে এনে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করলে সময় কমে যাবে।
চট্টগ্রামের বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, "এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। শিপিং কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ওয়্যার হাউজ থাকলে সেবার মান এবং পেশাদারিত্ব আরো বাড়বে। রপ্তানি প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হবে।"
চট্টগ্রামে ১৯ টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। এসব আইডিসিডিতে শতভাগ রপ্তানি পণ্য কন্টেইনার বোঝাই করার পাশাপাশি ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য ডেলিভারি এবং খালি কন্টেইনার সংরক্ষণ করা হয়।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, "কোয়ালিটি কন্ট্রোল প্রক্রিয়াটি নির্দিষ্ট ওয়্যার হাউজে করার কারণে কারখানা থেকে ডিপোতে আসার পণ্য চুরি, ড্যামেজ হলে সেগুলো নির্ণয় করা সহজ হয়। এতে উৎপাদন শেষে জাহাজীকরণ প্রক্রিয়ায় সময় কমে আসবে। এর সুফল পাবে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।"
তিনি আরো বলেন, আরো কয়েকটি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার ডেডিকেটেট ওয়্যার হাউজ করার জন্য লাইসেন্স পেতে কাস্টম বন্ড কমিশনারেটে আবেদন করেছে।
নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের রপ্তানি পণ্য জাহাজে তোলার আগে কন্টেইনার ভর্তি করতে হয় চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোতে। এরপর জাহাজের শিডিউল অনুযায়ী সেগুলো ডিপো থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে জাহাজে তোলা হয়। কারখানা থেকে ডিপোতে পণ্য এনে রাখার জন্য ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিপোতে নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ নেয়। সব ডিপোতেই বৃহৎ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা জায়গা থাকে।
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, "গ্লোবাল জায়ান্ট শিপিং কোম্পানিগুলোর ওয়্যার হাউজ সিস্টেমের কারণে রপ্তানি পণ্য স্টাফিং প্রক্রিয়ায় সেবার মান উন্নত হবে। প্রতিযোগিতা তৈরী হবে। আমরা এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাই।"