শুল্ক বৃদ্ধিতে বাড়বে সিমেন্টের দাম, বাড়বে নির্মাণ ব্যয়ও
নতুন বাজেটে প্রস্তাবিত শুল্ক কাঠামোতে প্রতি বস্তা সিমেন্টের উৎপাদন খরচ ১৫ টাকা বাড়ার কথা থাকলেও উৎপাদনকারীরা খুচরা পর্যায়ে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা বাড়ানোর কথা ভাবছে, যা সব পর্যায়ে নির্মাণ ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে।
নির্মাতা ও ঠিকাদারদের আশঙ্কা, নির্মাণকাজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সিমেন্টের এরকম আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি রডসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দেবে। আগে থেকেই এসব পণ্যের দাম চড়া ছিল।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিঙ্কারের আমদানি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের জন্য আমদানি পর্যায়ে প্রতি টন ক্লিঙ্কারের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন আমদানি করা ক্লিঙ্কার দিয়ে তৈরি সিমেন্ট বাজারে আসার পর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিমেন্টের দাম খুচরা পর্যায়ে বস্তাপ্রতি ৫৮০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে কারখানা মালিক ও ডিলাররা ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি বস্তা সিমেন্ট খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকায়।
ঠিকাদাররা বলছেন, এই পরিস্থিতি তারা বিপাকে পড়বে, কারণ তারা বিভিন্ন প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়েছে সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধির আগে।
সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা যা বলছে
বাজেট পাশ হওয়ার আগেই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১ জুন থেকে সিমেন্ট ক্লিঙ্কারের নতুন হারে শুল্ক আরোপ করছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার ব্যারিস্টার বদরুজ্জামান মুন্সি।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শীঘ্রই কারখানা গেটে সিমেন্টের দাম ব্যাগপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
তিনি বলেন, 'সিমেন্ট কারখানা মালিকরা খরচের সাথে সমন্বয় করে নিজস্ব কোম্পানির সিমেন্টের দাম নির্ধারণ করেন। আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির কারণে যে বাড়তি ব্যয় হবে, সে হারে সিমেন্টের দাম বাড়বে।
'ইতোমধ্যে ডলারের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলার সংকটের কারণে বেড়ছে নানামুখী খরচ। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এসব বাড়তি খরচও অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।'
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর (বিসিএমএ) সেকেন্ড ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, ১২ জুন তাদের ১৩ হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট ক্লিংকার খালাস হবে। এসব পণ্য খালাসে আমদানি শুল্ক বাবদ বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হবে তাদের।
তিনি বলেন, 'বাজেট পাশ হওয়ার পর সিমেন্টের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে আমাদের। আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য কর খাতে যে পরিমাণ বাড়তি টাকা ব্যয় হবে, আমরা ততটুকুই দাম বাড়াব।'
চট্টগ্রামের খুচরা সিমেন্ট ব্যবসায়ী, ফাহিম ট্রেডার্সের মালিক আরমান চৌধুরী বলেন, খুচরা পর্যায়ে একেক অঞ্চলে একেক দামে সিমেন্ট বিক্রি হয়। দামের তারতম্য নির্ভর করে পরিবহন ব্যয়ের ওপর।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কয়েকজন কারখানা মালিক ইতিমধ্যে তাকে জানিয়েছেন যে সিমেন্টের দাম বাড়বে।
বিভিন্ন পর্যায়ে সিমেন্টের দাম
মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট লজিস্টিকস সমস্যা ও পণ্য পরিবহনে জাহাজভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় আগে থেকেই চাপে ছিল সিমেন্ট শিল্প।
এর মধ্যেই উৎপাদন খরচ ফের বেড়ে গেলে খুচরা পর্যায়ে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট ৫৮০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন কারাখানা মালিক ও ডিলাররা। এতে বাধাগ্রস্ত হবে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
বর্তমানে কারখানা পর্যায়ে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৪৮০ টাকায়।
ডিলার পর্যায়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায়।
আর খুচরা পর্যায়ে প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫২০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকায়।
শুল্কবৃদ্ধির প্রভাব
বিসিএমএ-র ফার্স্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও মেট্রোসেম সিমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে তারা চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ সিমেন্ট ক্লিঙ্কার আমদানি করতে পারছেন।
তিনি বলেন, 'প্রাক-বাজেট আলোচনায় সরকারের কাছে আমদানি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আর আগাম আয়করের বিষয়ে আমাদের জোরালো দাবি ছিল ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করা।
'কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, উল্টো ক্লিঙ্কারে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।'
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতিমধ্যেই উচ্চ কর, জ্বালানি সংকট, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ও ডলার সংকটে হাঁসফাঁস করতে থাকা খাতটির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসবে এই শুল্কবৃদ্ধি।
তারা বলেন, গত দুই বছরে প্রায় প্রতিটি নির্মাণ সামগ্রীর দাম ১৮ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের রিয়েল এস্টেট শিল্প।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব-এর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কৈয়্যুম চৌধুরী বলেন, এমনিতেই নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের আবাসান খাত চরম সংকটের মাধ্যে রয়েছে।
'তার ওপরে ক্লিঙ্কারের শুল্ক বাড়ানোর ফলে নির্মাণ শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে,' বলেন তিনি।
এতে সরকারের রাজস্ব আয় না বেড়ে উল্টো কমবে বলে সতর্ক করে তিনি বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান।
এদিকে সিমেন্টের আমদানি শুল্ক কমিয়ে টনপ্রতি ২০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছে সিমেন্ট কারখানা মালিকদের সংগঠন বিসিএমএ।
এমন পরিস্থিতিতে সংগঠনটি ১২ জুন সোমবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
বিসিএমএর নেতারা বলছেন, ক্লিঙ্কারের ওপর নতুন আমদানি শুল্ক ধার্য করার ফলে কাস্টমস ডিউটি দাঁড়ায় আমদানি মূল্যের প্রায় ১২-১৩ শতাংশ, যা অন্যান্য আমদানির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ঠিকাদাররা যা বলছে
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক সভাপতি শফিকুল হক তালুকদার টিবিএসকে বলেন, সিমেন্টের এই মূল্যবৃদ্ধির বোঝার পুরোটাই চাপবে ভোক্তার কাঁধে।
এছাড়াও সরকারি যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে, সেগুলোর ওপরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এসব প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির আগের হিসাবে।
শফিকুল হক বলেন, 'এখন যদি সিমেন্টর দাম বাড়ে, সেখানে ঠিকাদারদের নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হবে। এতে করে চলমান প্রকল্পগুলোর কাজের গতি আরও ধীর হয়ে যাবে।'
বাংলাদেশ ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেজবাউর রহমান রতন বলেন, দেশের মোট নির্মাণ সামগ্রীর প্রায় ৩০ শতাংশ সরকারি প্রকল্পগুলোতে ব্যবহার হয়।
আব্দুল মোনেম কন্সট্রাকশন লিমিটেডের বস্থাপনা পরিচালক এএসএম মঈনউদ্দীন মোনেম টিবিএসকে বলেন, দেশের বড় প্রকল্পের ঠিকাদাররা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আগে থেকেই বেকায়দায় আছে। এর মধ্যে সিমেন্টের দাম বাড়লে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
গত বছরের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চ বাজারদরসহ নানা কারণে সরকারের সাত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিচালিত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার ১,০১৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল।
রিহ্যাবের পরিচালক নাঈমুল হাসান বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে রাজধানীতে আবাসিক ভবন নির্মাণ কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। 'এ বছরে হাতেগোনা কিছু আবাসন কোম্পানি নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পেরছে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশে সিমেন্ট
বাংলাদেশে ৩৪টি সিমেন্ট উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে চারটি বহুজাতিক।
এসব কোম্পানির সিমেন্ট উৎপাদনের সক্ষমতা ১০ কোটি টন।
তবে অর্থনৈতিক চাপের কারণে গত বছর দেশে মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টন সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে।
গত সাত বছরে সিমেন্ট শিল্পের চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১১.৫ শতাংশ।
২০২২ সালে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ছিল প্রায় ২৫০ কেজি, যা দুই দশক আগে ছিল ৪৫ কেজি।
সিমেন্ট বাজারের ৮০ শতাংশের বেশি ১০টি কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।