আদা, চিনি, গমের সরবরাহ সংকটের মধ্যে লিটারে ১০ টাকা কমলো সয়াবিনের দাম
এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ৪৭ শতাংশ কমলেও দেশের বাজারে লিটারে মাত্র ১০ টাকা দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। তবে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও সরবরাহ সংকটের কারণে বাজারে আদা, চিনি ও গমের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না এবং ভোক্তাদের অতিরিক্ত দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে।
রোববার (১১ জুন) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ৭ম সভায় ভোগ্যপণ্যের বর্তমান সরবরাহ পরিস্থিতির উপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এই প্রতিবেদনে সরবরাহ ঘাটতির তথ্য উঠে আসে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ পরিস্থিতির উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসের চাহিদা বিবেচনায় চিনি, গম ও আদার সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে চিনির সরবরাহ ঘাটতি ৭২ হাজার মে. টন, আদার ৭৭ হাজার মে. টন এবং গমের ঘাটতি ২৪ লাখ ১১ হাজার মে. টন।
জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি ও আদা ছাড়া সব পণ্যের দাম কমতির দিকে। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাবার কারণে এই সুবিধাটা নিতে পারছে না বাংলাদেশ।
তবে টাস্কফোর্সের এই সভায় এখন থেকে প্রতি লিটার প্যাকেটজাত সয়াবিন তেল ১০ টাকা কমিয়ে ১৮৯ টাকা আর খোলা সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিগুলো। একইসাথে পাম অয়েলের দাম ২ টাকা কমিয়ে প্রতি লিটার খুচরা পর্যায়ে ১৩৩ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ভোজ্যতেলের দাম আরও কমানো যায় কিনা তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে আদার সংকট আছে। সমাধানের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, গম আমদানি এক বছরের ব্যবধানে ২৪ লাখ টন এবং চিনি আমদানি কমেছে ৭২ হাজার টন। আমদানি কম হওয়ার প্রভাব পড়েছে বাজারে।
চিনির বাৎসরিক চাহিদা ২০ লাখ মে. টন, কিন্তু ডলার সংকট ও আমদানি কম হওয়ার কারণে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব রয়েছে বাজারে। সরকার সর্বশেষ খোলা ও প্যাকেটের চিনির দাম ১৬ টাকা করে বাড়িয়ে ১২০ ও ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এরপরও বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ঢাকার বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়। খুচরা বাজারে তো নেই-ই, সুপার শপগুলোতে এখন প্যাকেটের কোন চিনি নেই।
একই অবস্থা গমের বাজারেও। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই গমের আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। নিজেদের নিরাপত্তায় জোর দিয়ে রপ্তানি বন্ধ করার পর প্রধান আমদানির উৎস ভারত থেকেও আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে বড় ধরনের সরবরাহ ঘাটতি। এ কারণে বাজারে এখন আটার দাম (খোলা-প্যাকেট) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩-২৫ শতাংশ বেশি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে আদা উৎপাদন হলেও সেটা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। যে কারণে আমদানির উপরেই বাজার নির্ভরশীল। এই আমদানির বেশিরভাগই হতো চায়না থেকে। কিন্তু মাসখানেকেরও বেশি সময় ধরে চীন থেকে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এখন যেটা আসছে তারও ৮০ শতাংশের বেশি মিয়ানমার থেকে। যদিও এটা দিয়ে ঘাটতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে আদার দাম ২২২% বেড়েছে। চীনের মতো বড় সরবরাহকারী না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্যটির দাম হু হু করে বাড়ছে। এক বছরের ব্যবধানে টনপ্রতি আদার দাম ১৭২% বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানা যায়, আদার ৬৫% স্থানীয় উৎপাদন থেকে মেটানো সম্ভব হলেও তা যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে লিন পিরিয়ডে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এডি ব্যাংকগুলো আমদানির জন্য যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করছে না। যে কারণে আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছে। শতভাগ এলসি মার্জিনের কারণে কস্ট অব ফান্ড বাড়ছে, ডলারের সরবরাহে ঘাটতির কারণে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে ডলার ক্রয় করায় ব্যয় বাড়ছে।
এ সময় অবশ্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ভূমিকা বাড়ানোরও বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহ করে বিক্রি করায় দেশের মোট মজুদে টিসিবির সংগৃহীত পণ্য কোন ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে না।
আমদানিকারকদের দাবি, আমদানি করা পণ্য যথাসময়ে খালাস করতে না পারায় জাহাজের ডেমারেজ চার্জের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়ছে। দ্রুত পণ্য খালাস না হওয়ায় বাজারেও নিরবচ্ছিন্ন পণ্য সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। অত্যাবশ্যকীয় কিছু পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও সে অনুযায়ী শুল্ক কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন না করার ফলে ইনভয়েস মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে শুল্কায়ন করা হচ্ছে।