বাংলা কিউআর কোডকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে বড় পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক
ক্যাশলেস সোসাইটি হিসেবে দেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে বাংলা কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোডকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, আসন্ন কোরবানির ঈদের গরুর হাটকে কেন্দ্র করে আপাতত এগোতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ উপলক্ষে সারাদেশের প্রায় ১০,০০০ গরুবিক্রেতা ও খামারির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়া চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, গরুর হাটগুলো ঠিকমতো বসার আগেই এসব অ্যাকাউন্ট খোলা হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ ২৬টি ব্যাংকের সঙ্গে সভা করেছে। এছাড়া, তারা গরু খামারি ও বিক্রেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৮টি হাট ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২টি হাটে এবার বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্ট করা যাবে। এই হাটগুলোর প্রতিটির দায়িত্বে থাকবে এক একটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা হাটে একটি বুথ স্থাপন করবেন। এসব বুথে পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিন ও এটিএম থাকবে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদও থাকবে বলে জানা গেছে।
শুধু গরুর হাট নয়, দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি হাসপাতালগুলোতেও চালু হচ্ছে বাংলা কিউআর। বর্তমানে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এটি ব্যবহার করে এখন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ফি পরিশোধ করতে পারছেন। ধীরে ধীরে এটি দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালেও পেমেন্ট করা যাবে বাংলা কিউআর কোড ব্যবহার করে।
বাংলা কিউআর কোডকে জনপ্রিয় করে তুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই ঢাকা মহানগরীসহ গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, নাটোর ও রংপুর জেলায় প্রচারণা শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ডিজিটাল পেমেন্ট করতে পারবেন। এক্ষেত্রে পেমেন্ট গ্রহীতার অন্য যেকোনো ব্যাংকে বা এমএফএসে অ্যাকাউন্ট থাকলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে টাকা পেয়ে যাবেন। এসব ক্ষেত্রে পেমেন্ট প্রদানকারী বা গ্রহীতা, কাউকেই বাড়তি কোনো খরচ করতে হবে না।
কোরবানির পশুর হাটকেই কেন প্রাথমিক লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, "আমরা গরুব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, নগদ টাকা পরিবহনে তাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তারা আমাদের এমনও বলেছেন, ঢাকা থেকে খামারির এলাকা পর্যন্ত নগদ টাকা নিরাপদে পরিবহনের জন্য তারা প্রতি হাজারে ২০/৩০ টাকার বিনিময়ে অনেকটা কুরিয়ার সিস্টেমে টাকা পাঠান।"
"এতে তাদের অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এছাড়া, অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে অনেক গরু বিক্রেতা ও খামারির টাকা লুট ও সর্বশান্ত হওয়ার মতো খবর আমরা প্রতি কোরবানির ঈদের আগেই পেয়ে থাকি। বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন হলে এ ধরনের শঙ্কা আর থাকবে না। গত ঈদেও আমরা স্বল্প পরিসরে সার্ভিসটি গরুর হাটগুলোতে চালু করেছিলাম। আমরা সবার কাছে থেকে অনেক ভালো রিভিউ পেয়েছি। অনেক গরু খামারি আমাদের এমনও বলেছেন, কিউআর কোডের মাধ্যমে গরু বিক্রির টাকা সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ায় ও ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে গরু কেনার সুযোগ পাওয়ার কারণে তাদের বিক্রি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের পরিচালক মোঃ মোতাছিম বিল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "কার্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে অনেক দেশই ক্যাশলেস সোসাইটিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেসব দেশের এবং আমাদের অর্থনৈতিক পরিবেশ ভিন্ন। তবে এটি সম্ভব। বাংলা কিউআর এর মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।"
বাংলা কিউআর ছড়িয়ে দিতে তহবিল প্রয়োজন
চলতি বছর বাংলা কিউআর কোডের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ৭.৫ কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হবে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরমধ্যে রয়েছে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা খরচ, গ্রাহকের খরচ ও ব্যাংকগুলোর খরচ।
তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, একটি ক্যাশলেস সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলা কিউআর কোডের বিপণন ও বাস্তবায়নে আলাদা কোনো ফান্ড গঠন করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্রুত ফান্ড না পেলে বাংলা কিউআর কোডের খুব বেশি বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে না।
এর আগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আগামী চার বছরের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেন নগদবিহীন করার জন্য চেষ্টা করা হবে। এই নগদবিহীন লেনদেনের একটি বড় অংশের জন্য বাংলা কিউআর কোড গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে তাদের সিএসআর ফান্ড থেকে কিছু টাকা নিয়ে বাংলা কিউআর কোডের পরিচালনায় খরচ করার জন্য বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিষয়টি জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলা কিউআর কোডের পরিচালনায় ও ব্যবস্থাপনায় টাকা প্রয়োজন। কারণ একটি দোকান বা প্রতিষ্ঠানে কিউআর কোড স্থাপন করা হলে সেটি একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর বদলানোর প্রয়োজন হয়। এছাড়া, ব্যাংকগুলো যে প্রক্রিয়ায় টাকা গ্রহণ করে ও অন্য ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠায়, সেখানেও একটা খরচ হয়।
"এসব কারণে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি ফান্ড গঠন করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে বাংলা কিউআর কোড ব্যবহার করে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের মধ্যে এটিকে অন্তত ১৩ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং জয়তুন বিজনেস সলিউশনের চেয়ারম্যান মোঃ আরফান আলী টিবিএসকে বলেন, "একটি সর্বজনীন বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে দেশের সমস্ত ব্যাংককে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি)-এর সঙ্গে সংযুক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি অবশ্যই ভাল উদ্যোগ।"
"বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এটি ছড়িয়ে দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়ে প্রচারণা বাড়ানোসহ আরও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে," যোগ করেন তিনি।