বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্লকে যোগদানের সুবিধা-অসুবিধা খতিয়ে দেখছে সরকার
চীনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্লক রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসেপ) যোগ দেওয়ার শর্ত ও সুবিধা-অসুবিধা পর্যালোচনা করছে সরকার।
গত বছরের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে ১৫ দেশের বাণিজ্যিক জোট আরসেপ। এই ১৫টি দেশের মোট জনসংখ্যা ২.৩ বিলিয়ন (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ), বাজারের আকার ২৬.৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে এ ব্লকে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে কোন কোন প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে, আনুষ্ঠানিকভাবে তা পর্যালোচনা করা শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসকে আরসেপে যোগ দিতে যেসব প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আরসেপে যোগ দিতে বাংলাদেশকেও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে হতে পারে। বাংলাদেশ এসব প্রতিশ্রুতির কতটা মেনে চলতে পারবে, তা পর্যালোচনা করতে আগামী মঙ্গলবার (১ জুলাই) একটি সভা ডাকা হয়েছে।
ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হক টিবিএসকে বলেন, 'আরসেপে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে একটি স্টাডি হয়েছে। সেই স্টাডি পর্যালোচনা করতে মঙ্গলবার সভা হবে।'
আরসেপে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে গত বছর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। তাতে এ জোটে যোগ দেওয়ার পক্ষে ইতিবাচক মতামতই উঠে এসেছে।
আরসেপের নিয়মানুযায়ী, যাত্রা শুরুর ১৮ মাস পর থেকে এই ব্লকে অন্তর্ভুক্তির জন্য যেকোনো দেশ আবেদন করতে পারবে। সে হিসাবে, ২০২৩ সালের জুন থেকে আগ্রহী দেশগুলো আরসেপে যোগদানের জন্য আবেদন করতে পারছে।
অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ট্যারিফ কমিশনের সমীক্ষা
ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় আরসেপে যোগদানের সুবিধা-অসুবিধাগুলো খতিয়ে দেখেছে। তাদের প্রতিবেদনে মূলত এ জোটে যোগ দেওয়ার পক্ষেই মত দেওয়া হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আরসেপে যোগ দিলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৭.৩৭ শতাংশ বাড়বে, যার পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
তবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির বড় অংশই আসবে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। ফলে পোশাক খাতে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে প্রায় ১৮ শতাংশ। আরসেপে যোগ দিলে দেশের জিডিপিও ০.২৩ শতাংশ বাড়বে।
সুবিধার পাশাপাশি বেশ কিছু অসুবিধার তথ্যও উঠে এসেছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক খাতের বাইরে সামগ্রিক শিল্প উৎপাদন কমে যেতে পারে। পাশাপাশি আমদানি শুল্ক থেকে বাংলাদেশের আয়ও কমে যাবে। বাংলাদেশ আরসেপে যোগ দিলে ভোক্তাদের সুবিধা হবে, তবে উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করার নেতৃত্বে ছিলেন ট্যারিফ কমিশনের তৎকালীন সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'এই ব্লকে যোগদানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ—অ্যাসেসমেন্ট, কমিটমেন্ট কমপ্লাই করার সক্ষমতা ও কী কী সুফল পাওয়া যাবে, তা পর্যালোচনা করা।'
'এর মধ্যে অ্যাসেসমেন্ট ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের মতো বাংলাদেশের সমপর্যায়ের অর্থনীতির যেসব দেশ আরসেপে যোগদান করেছে, তাদেরকে যেসব কমিটমেন্ট দিতে হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য সম্ভাব্য কমিটমেন্ট কমপ্লাই করার সক্ষমতা আছে কি না, তা স্পষ্ট হবে,' বলেন মোস্তফা আবিদ খান।
ট্যারিফ কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সরকার সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে আরসেপে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থান প্রকাশ করতে পারে।
আরসেপের সুবিধা-অসুবিধা
২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর ১৫টি দেশ—চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড; অ্যাসোসিয়েশন অভ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান)-এর ১০ সদস্য: ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন—বিশ্বের বৃহত্তম মুক্তবাণিজ্য চুক্তি আরসেপ স্বাক্ষর করে।
এ ব্লকে যোগ দিলে বাংলাদেশ অন্যান্য আরসেপ দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করবে, আবার সেই দেশগুলোও বাংলাদেশের মতো একই সুবিধা পাবে।
আরসেপে যোগদানের ফলে বাংলাদেশের বৈশ্বিক আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে—১৪.৪৬ শতাংশ—বাড়বে।
বাণিজ্য ব্যবস্থার এই উদারীকরণ অনেক দেশীয় শিল্পের ওপর প্রভাব ফেলবে। ওই শিল্পগুলো তখন আর এখনকার মতো সুরক্ষা পাবে না।
টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য, পরিবহন সরঞ্জাম, ধাতুপণ্য, কাগজ, লাইট, রাসায়নিক, ফার্মাসিউটিক্যালস ও উৎপাদন খাতে কিছুটা জায়গা নিতে পারে আমদানি করা পণ্য।
এর ফলে আরসিইপিতে যোগ দিলে নিজের রপ্তানি ঝুড়িতে ব্যাপক বৈচিত্র্য আনতে হবে বাংলাদেশকে। গত কয়েক বছর ধরেই অবশ্য বারবার এই আহ্বান জানাচ্ছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা।
২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভের পর বাংলাদেশ বেশ কিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে। এরই আলোকে আরসেপে যোগদানের সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন।
আরসিইপির ১৫টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ডে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায় বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই দেশগুলোতে বাংলাদেশ এ সুবিধা হারাবে।
আরসেপে যোগদানের অর্থ হচ্ছে এই বাজারগুলোতে রপ্তানি সুবিধাগুলো ধরে রাখা; অন্যদিকে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সুবিধাও থাকবে।
আরসেপের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আরএমজি খাতের সুবিধা। এর কারণ হচ্ছে, আরসেপে শীর্ষ ২০ রপ্তানি আইটেমই আরএমজি পণ্য—মোট রপ্তানির ৬৪ শতাংশই এসব পণ্যের দখলে।
কিন্তু ট্যারিফ কমিশন বলছে, এ রপ্তানির সিংহভাগই করবে একা পোশাক খাত, অন্যান্য বেশিরভাগ শিল্পের ওপরই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আরসেপে যোগ দিলে আরএমজি খাতের রপ্তানি ৫.০৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাড়তে পারে। এছাড়া টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য, মাংস ও পশুসম্পদ, পানীয় ও তামাকের মতো অন্যান্য কয়েকটি খাতের রপ্তানির ওপরও কিছু ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু অন্য বেশিরভাগ খাতের ক্ষেত্রেই তা হবে না।
ট্যারিফ কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, (আরসেপে যোগদান থেকে) শুধু পোশাক খাতেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পোশাক খাত ছাড়া সামগ্রিকভাবে শিল্প উৎপাদন ০.৪৬ শতাংশ কমবে।
বাংলাদেশ আরসেপে যোগ দেওয়ার পর রপ্তানি যে পরিমাণ বাড়বে তা দিয়ে আমদানি বৃদ্ধির খামতি পূরণ করা যাবে না। আমদানি-রপ্তানি দুটোই বাড়বে। তবে আমদানি বাড়ার ফলে বেশিরভাগ দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ঘাটতি ২.৬৯ শতাংশ বাড়বে।
আরসেপ থেকে বাংলাদেশ আমদানিই বেশি করে। এ ব্লকে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির মাত্র ১০ শতাংশ যায়, বিপরীতে মোট আমদানির ৪৫ শতাংশই হয় এখান থেকে।
বাংলাদেশ ও আরসেপ উভয়পক্ষই যদি শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়, তাহলে দুই পক্ষেরই আমদানি বাড়তে পারে। যদিও বাংলাদেশের আমদানি বাড়বে অনেক বেশি।
এর ফলে রাজস্ব ক্ষতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশের। প্রক্ষেপণ অনুসারে, আরসেপ ৫৪১ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়লেও বিপরীতে বাংলাদেশ ২.৫ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়বে।
২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আমদানির ৪৩.৯২ শতাংশ, কর আয়ের ৫৫.৩৩ শতাংশ ও কাস্টমস ডিউটির ৫৮.৫৬ শতাংশ আসে আরসেপভুক্ত দেশগুলো থেকে।
আরসেপের ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি ও রাজস্ব আয় হয় চীন থেকে। দেশটি থেকে মোট আমদানির ৪৫ শতাংশ ও রাজস্ব আয়ের ৪৪ শতাংশ আসে।