অপরিশোধিত চিনির চেয়ে কম দামে পরিশোধিত চিনি শুল্কায়ন, শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ
পরিশোধিত চিনি আমদানিকারকদের একটি চক্র আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় সরকার এই খাত থেকে রাজস্ব হারাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্টেকহোল্ডাররা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত চিনির (র সুগার) তুলনায় পরিশোধিত চিনির (রিফাইন্ড সুগার) দাম প্রায় ১০০ ডলার বেশি।
তারা বলছেন, দামের এমন পার্থক্য সত্ত্বেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজসহ বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়ে পরিশোধিত চিনির শুল্কায়ন হচ্ছে অপরিশোধিত চিনির চেয়ে কম দামে। এর ফলে ঘটছে আন্ডার ইনভয়েসিং ও শুল্ক ফাঁকির ঘটনা। এতে রিফাইন্ড সুগার আমদানি খাতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে শুল্কায়ন হওয়া একাধিক পণ্য চালানে অপরিশোধিত চিনির চেয়ে কম দামে পরিশোধিত চিনি শুল্কায়নের সত্যতা মিলেছে বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই করে পরিশোধিত চিনির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য (অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু) নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশন।
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'বিশ্ববাজারে র সুগার-এর মূল্য প্রতি মেট্রিক টনে প্রায় ৬০০-৬৫০ মার্কিন ডলার এবং রিফাইন্ড সুগার প্রায় ৭৫০ মার্কিন ডলার। অথচ রিফাইন্ড সুগারের শুল্কায়নে টনপ্রতি আমদানি মূল্য দেখাচ্ছে ৪৫০ ডলার থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত। এতে রিফাইন্ড সুগার আমাদানিতে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে এই খাতের ব্যবসায়ীরা।'
প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে পরিশোধিত চিনি আমদানি দেখিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি রোধ করতে আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই করে পরিশোধিত চিনি শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণের জন্য অনুরোধ জানায় সংগঠনটি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে শুল্কায়ন হওয়া পরিশোধিত চিনির কয়েকটি চালান পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিটন পরিশোধিত চিনি শুল্কায়ন হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫৮০ ডলারে। আর অপরিশোধিত চিনি শুল্কায়ন হয়েছে ৬০০ থেকে ৬৫০ ডলারে।
একাধিক অপরিশোধিত চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধতন কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত চিনির চেয়ে পরিশোধিত চিনির দামের তারতম্য থাকে প্রায় ১০০ ডলার। অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে সেগুলোকে পরিশোধন করতে কোম্পানিগুলোর প্রায় ১০০ ডলার খরচ হয়। ফলে কোনোভাবেই অপরিশোধিত চিনির চেয়ে পরিশোধিত চিনির মূল্য কম হওয়ার সুযোগ নেই।
চিনি আমদানিকারক আবদুল মোনেম লিমিটেডের হেড অব কমার্স আজিজ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমরা টনপ্রতি ৬০০ থেকে ৬৫০ ডলার মূল্যে র সুগার আমদানি করছি। সেই হিসেবে রিফাইন্ড সুগার কীভাবে এর চেয়ে কম মূল্যে আমদানি করছে, তা বোধগম্য নয়।"
প্রকৃত মূল্য গোপন করে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধিত চিনি খাতের আমদানিকারকরা শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জয়েন্ট কমিশনার তারেক হাসান বলেন, "আমার জানামতে এখন আগের তুলনায় বেশি মূল্যে রিফাইন্ড সুগার শুল্কায়ন হচ্ছে। বর্তমানে রিফাইন্ড সুগারের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য (অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু) যদি র সুগারের চেয়ে কম হয়, তাহলে এগুলো পুরোনা এলসিতে আমদানি করা হয়ে থাকতে পারে।"
বর্তমান কাস্টম ট্যারিফ অনুযায়ী, পরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি কাস্টম ডিউটি (সিডি) ৬ হাজার টাকা, আরডি (রেগুলেটরি ডিউটি) ৩০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অ্যাডভান্স ট্যাক্স (এটি) ৫ শতাংশ এবং অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি কাস্টম ডিউটি (সিডি) ৩ হাজার টাকা, রেগুলেটরি ডিউটি ৩০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এটি ৫ শতাংশ এবং অ্যাডভান্স ট্যাক্স ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চিনির বার্ষিক চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন। স্থানীয় চিনিকলগুলোতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়। চাহিদার বাকি অংশ পূরণ হয় দেশের রিফাইনারি কোম্পানিগুলো দ্বারা অপরিশোধিত চিনি আমদানির পর তা পরিশোধন করে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে।
দেশে মোট আমদানি করা চিনির প্রায় ৯৫ শতাংশই অপরিশোধিত চিনি। ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং মালয়েশিয়া থেকে এসব চিনি আমদানি করা হয়। বাকি ৫ শতাংশ পরিশোধিত চিনি আমদানি করে বিভিন্ন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি, আইসক্রিম, ডেইরিসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান।