একক বিনিময় হার যে কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ঠেকাতে পারেনি
গত ৩ জুলাই দেশের ইতিহাসে একদিনে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন হয়। তবে এরপরও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অর্থ হচ্ছে, ডলারের এক দাম এখনও নির্দেশিত। ডলারের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত ও বাজারদরের (প্রকৃত দাম) মধ্যে পার্থক্য এখন ৫ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির সময় আন্তঃব্যাংক রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম ধরেছে ১০৯.৫০ টাকা। কিন্তু বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিংহভাগ ব্যাংকই আনুষ্ঠানিক দাম না মেনে ডলারপ্রতি ১১৪ থেকে ১১৬ টাকা রেটে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলছে।
বাজারে ডলারের দাম এখনও বেশি থাকায় আমদানি ব্যয় মেটাতে জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ১.১৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে এই ধারা দেখা যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য দেশ যে চ্যালেঞ্জে রয়েছে, সেদিকেই ইঙ্গিত করছে এই ধারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, এই পরিমাণ ডলার ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমান, টাকার হিসাবে যা এক মাসে সর্বোচ্চ। ডলারের চড়া দামের—১০৮-১০৯ টাকা—কারণেই এত বেশি টাকা ব্যয় হয়েছে।
ডলারের এক দাম চালু করার উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো। কিন্তু এই উদ্যোগ প্রত্যাশিত ফল এনে দিতে পারেনি।
গত ১৩ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালান্স অভ পেমেন্টস ও ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করতে আরম্ভ করে। এরপর থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিপিএম৬ অনুযায়ী ২ আগস্ট গ্রস রিজার্ভ ২৩.৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গত ১৪ জুলাই গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার। আমদানির সাম্প্রতিক ধারা অনুযায়ী এই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো পর্যাপ্ত রিজার্ভ রাখতে হয়।
এর আগে গত ৩ জুলাই দেশের ইতিহাসে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন করা হয়। ওই দিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০৮.৮৫ টাকা আন্তঃব্যাংক রেটে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে স্থানীয় মুদ্রার ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৮৫ পয়সা অবমূল্যায়ন হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল একাধিক বিনিময় হারভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে বাজারভিত্তিক একটি একক বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো। একইসঙ্গে গত জানুয়ারিতে আইএমএফের অনুমোদিত ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণেরও অন্যতম শর্ত ছিল ডলারের এক দাম চালু করা। আর সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পদক্ষেপ নেয়।
পরে আন্তঃব্যাংক রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১ আগস্ট পর্যন্ত আরও দুবার টাকার অবমূল্যায়ন করে ডলারের দাম ১০৯.৫ টাকায় উন্নীত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এই ঘোষিত রেট নির্দেশিত হওয়ায় আন্তঃব্যাংক বাজার লেনদেন অকার্যকর থেকে যায়।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অভ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম ১০৯.৫০ টাকা, রপ্তানিতে ১০৮.৫০ টাকা, রেমিট্যান্সে ১০৯ টাকা ও আমদানিতে ১০৯.৫০ টাকা ঘোষণা করে। কিন্তু এই ঘোষণা কাগজে-কলমেই থেকে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে ব্যাংকাররা বলেন, অনেক ব্যাংক রেমিট্যান্স কিনছে ১১৩ টাকার বেশি দামে, আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে ১১৪ টাকার বেশি দামে।
অন্যতম বৃহৎ একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের দায়িত্বে থাকা একজন সিনিয়র ব্যাংকার টিবিএসকে বলেন, আমদানি ও রেমিট্যান্সের দামের মধ্যে সর্বোচ্চ ০.৫০ টাকার পার্থক্য হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে এখন একটি একক বিনিময় হার চালু রয়েছে। কিন্তু এই রেট কেবল কাগজে-কলমেই আছে।
ওই ব্যাংকার বলেন, বেশিরভাগ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে এই রেট দাম ঘোষণা করলেও, তারা ঘোষিত রেটের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করার জন্য আলাদা হিসাব রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ব্যাপারে জানে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাইকারি মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. এনায়েত উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, তিনি ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে এলসি খোলেন। এই ব্যাংক দুটিতে তিনি এলসি খোলার জন্য ডলার রেট ১১৪ টাকা পান। একইসঙ্গে তিনি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকও। ওই ব্যাংকেও আমদানি এলসির জন্য ডলারের দাম ১১৪ টাকা রাখা হয়।
এনায়েত উল্লাহ বলেন, বাজারে ডলারের সংকট রয়েছে। ফলে অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না। তাই ব্যাংকগুলো ১১৪ টাকায় এলসি খুলতে রাজি হলেও তারা খুশিই হন।
মেগা প্রকল্পের কাঁচামাল আমদানি করা আরেক আমদানিকারক নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, গত সপ্তাহে তিনি এনসিসি ব্যাংকে ১১৩.৫০ টাকায় এলসি খুলেছেন।
ওই আমদানিকারক আরও জানান, ডলারের রেট বেশি রাখে, এমন একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
সিটি গ্রুপের পরিচালক (ব্র্যান্ড) বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, এলসির খোলার জন্য ১১৬ টাকা দিয়েও ডলার পেতে সমস্যা হচ্ছে তাদের। কয়েকটি ব্যাংকে তারা ১১৫-১১৬ টাকায় এলসি খুলেছেন। তবে তাদের ব্যবসার সমস্যা হবে বলে বিশ্বজিৎ ঋণদাতার নাম জানাতে রাজি হননি।
বিশ্বজিৎ বলেন, শুধু সিটি গ্রুপই নয়, অন্য বড় আমদানিকারকরাও সুবিধাজনক রেটে এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছে।
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শাহাম তসলিম শাহরিয়ার জানান, তারাও ১১৫-১১৬ টাকায় এলসি নিষ্পত্তি করছেন।
এই পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের আমদানি পেমেন্ট দিতে বিলম্ব করছে বলে জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছে কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক। সেই অভিযোগপত্রের একটি কপি এসেছে টিবিএসের হাতে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার বলেন, তাদের ডলারের সংকট নেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধে বিলম্ব হয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি।
জনতা ব্যাংকের যেহেতু ডলার সংকট নেই, কাজেই তারা বাফেদা-নির্ধারিত আমদানি রেট মানছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি আমদানির জন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনছেন।
'আমরা অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কেনার চেষ্টা করছি না, কারণ একেক ব্যাংক একেক দাম রাখছে,' বলেন তিনি।
সাধারণত আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলার পাওয়া গেলে কোনো ব্যাংককে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিনতে হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এ বছরের জুলাইয়ে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ছিল গড়ে ৭০ মিলিয়ন থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে একই পরিমাণ ডলার বিক্রি করেছে।
অন্যদিকে সংকটের আগে, যখন একক বিনিময় হার ছিল, তখন আন্তঃব্যাংক লেনদেন ৩০০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে ছিল।
এবিবির সভাপতি সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, ব্যাংকগুলোর উচিত বাফেদার ঠিক করে দেওয়া আমদানি রেট মেনে চলা।
যেসব ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে ঘোষিত দরে ডলার বিক্রি করতে পারছে না, তাদের এলসি খোলা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ডলারের সংকটের কথা স্বীকার করে সেলিম বলেন, ব্যাংকগুলোকে তাদের সামর্থ্যের মধ্যেই বাফেদা-নির্ধারিত রেট মেনে এলসি খুলতে করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যাংক নির্ধারিত রেট মানছে না, এমন কোনো তথ্য তার কাছে নেই। কোনো আমদানিকারক যদি নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দামে এলসি খোলে, তাহলে ঋণদাতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের অভিযোগ জানানো উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বাফেদাকে রপ্তানি, আমদানি ও রেমিট্যান্সের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার ঠিক করার নির্দেশ দেয়।
ডলারের দাম বেড়ে ১১৫ টাকায় দাঁড়ালে, মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে আনতে একাধিক বিনিময় হারের এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। তবে কিছু সময়ের জন্য ডলারের দাম ১১০ টাকার নিচে নেমে এলেও এই নির্দেশিত বিনিময় হারের কারণে তা ফের ১১৫ টাকার ওপরে উঠে যায়।
ডলারের এক দাম যেহেতু নির্দেশিত ছিল, তাই আমদানি সীমিত করেও বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারেনি।
গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়কালে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ ২১ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
ডলার সংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে রাজি না হওয়ায় মোট আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ গত অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার মানে হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধীর হয়ে গেছে—যা অদূর ভবিষ্যতে রপ্তানির ওপর আরও প্রভাব ফেলবে।
ডলার সাশ্রয়ের জন্য আমদানি সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু নির্দেশিত ডলার রেটের কারণে তা কার্যকর হয়নি বলে মন্তব্য করেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।