পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতা নিরসনে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ
ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে ঢাকার বাজারে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকায় উঠেছে। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে ১৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
পেঁয়াজের বাজারে তৈরি হওয়া এই অস্থিরতা নিরসনে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন আমদানির উপর থাকা ১০ শতাংশ শুল্ক অব্যাহতি প্রদানের অনুরোধ করেছে। শুল্ক কমানোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি এবং ৫ শতাংশ এআইটি সহ মোট ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা রয়েছে। এদিকে গত ১৯ আগস্ট ভারত স্থানীয় বাজারের সুরক্ষার জন্য পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে জানায় ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়।
শুল্ক কমানোর পাশাপাশি বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে জোর দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। এর আগে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা নিরসনে তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তান, মিয়ানমার সহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে দেখা গেছে।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করেছে। বর্তমানে ভারতে প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য ২৮০-৩০০ ইউএস ডলার। ৪০ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপের কারণে আমদানি মূল্য দাঁড়াবে ৪০০-৪২০ ইউএস ডলারে।
সাধারণত দেশে প্রতি বছর আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। আমদানির খরচ কমিয়ে আনতে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুল্ক প্রত্যাহার করে ভারতের বিকল্প আমদানি উৎস হিসেবে মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিশর থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য টিসিবি ও বেসরকারি আমদানিকারদেরকে উৎসাহিত করা যায়। যার মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের মূল্য ও সরবরাহে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
দেশি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা
ভারতের রপ্তানি মূল্যের উপর ৪০ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপের ঘোষণায় দেশে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এই অস্থিরতার আঁচে দেশি পেঁয়াজের দাম ৮০-৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
একইভাবে আমদানি হয়ে আসা ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ৬৫-৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৫-৮০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। যদিও বাড়তি রপ্তানি মূল্যের কোন পেঁয়াজ এখনো দেশে প্রবেশ করেনি।
তবুও ভোমরা স্থলবন্দরে দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৫ টাকা বেড়েছে।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স সৃষ্টি ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী দিপু রায় জানান, ভারতে শুল্ক নির্ধারণের পূর্বে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হতো ৪৫-৫০ টাকায়। এখন আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বন্দরে প্রতিকেজি পেঁয়াজে ১৫ টাকা করে বাড়তি দাম নেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া আমদানি কম এবং পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
ভারত রপ্তানি মূল্যের ঘোষণা দেয় ১৯ তারিখ, এই ঘোষণার রাত থেকেই পাইকারী বাজারে বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করে পাইকারী বিক্রেতারা। কারওয়ানবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একদিনের ব্যবধানে ৭৫-৭৬ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয় ৮৫-৯০ টাকা কেজি দরে। এর প্রভাব খুচরা বাজারে পড়তে শুরু করেছে।
কারওয়ানবাজারের আড়তদার মিন্টু টিবিএসকে বলেন, 'ভারত দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাবনা, ফরিদপুরের পাইকাররা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে পেঁয়াজ ছাড়ছেও কম। যে কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
সোমবার সরেজমিন ঢাকার কারওয়ানবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বাড্ডা, শান্তিনগর সহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, কিছু বিক্রেতা ৮০-৮৫ টাকায় দেশি পেঁয়াজ এবং ৭০ টাকায় আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করছে।
বাড্ডার মুদি দোকানি শামসুন নাহার টিবিএসকে বলেন, 'পেঁয়াজ আজকে থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে, এটা পাবনার পেঁয়াজ। তবে ফরিদপুরের কিছু পেঁয়াজ আছে যেগুলো ৯০ টাকায় বিক্রি করছি।'
পাশের আরেক দোকানি শরিফুল ইসলাম পেঁয়াজের বস্তা খুলতে খুলতে জানালেন, '১০০ টাকার কমে দেশি পেঁয়াজ বিক্রির সুযোগ নেই।'
আমদানি পরিস্থিতি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ৩৫ লাখ টনের বেশি। চাহিদার বেশি উৎপাদনের পরও আমাদের আমদানি নির্ভরতা থাকার বড় কারণ হচ্ছে 'পোস্ট হারভেস্ট লস'।
বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের (বিনা) তথ্য বলছে, পেঁয়াজের পোস্ট হারভেস্ট লস ২৫ শতাংশ। প্রতি বছর শুধু এই ক্ষতির কারণেই পেঁয়াজে ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা। যে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেটাই আবার আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন বলছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে ৭০-৭৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করা যায়, বাকিটা আমদানি করতে হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের তথ্য বলছে, আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর থেকে ২০ আগষ্ট পর্যন্ত মোট ৩.৬৫ লাখ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। কিন্তু সরকার ১৩.০৪ লাখ টনের বেশি অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ অনুমতি দেওয়া পেঁয়াজের মাত্র ২৭.৬৪ শতাংশ দেশে এসেছে।
গত অর্থবছরে ৭.৪৩ লাখ মে. টন পেঁয়াজ আমদানি হয়।
কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য
কৃষিমন্ত্রী ড. মো আব্দুর রাজ্জাক গত ২০ আগস্ট এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের জানান, দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, ভারতের সিদ্ধান্তে দাম বাড়বে না। কিন্তু রাত না পোহাতেই পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকায় উঠেছে।
সোমবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ভারতের বাইরে যেকোনো দেশ থেকে আমদানি করতে চাইলে ব্যবসায়ীদেরকে অনুমতি দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, "ইচ্ছা করলেই আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। এটা চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে। তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানে আমাদের কিছু করার নেই। একটাই আছে তা হলো অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে এবং শক্তভাবে বাজার মনিটর করতে হবে।"
এদিকে প্রতিদিন চাহিদা হিসেব করে দেখা গেছে, গড়ে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মে. টন পেঁয়াজের চাহিদা দেশে। এই পরিমাণ পেঁয়াজ থেকে যদি বাড়তি কেজিপ্রতি ১৫ টাকা ভোক্তার পকেট থেকে বেরিয়ে যায়, তার পরিমাণও ১১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।