মালয়েশিয়ায় শ্রমিক কোটা, আগস্টে সর্বোচ্চ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের রেকর্ড
চলতি বছরের আগস্টে জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধরনের বৃদ্ধি দেখেছে বাংলাদেশ। ১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিকভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি শুরু হওয়ার পর আগস্টে (চলতি বছর) একমাসে সর্বোচ্চ ১,৩৮,৬৭৫ জন শ্রমিক বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার উদ্বেগের মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে এই বৃদ্ধি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য পূর্ব-নির্ধারিত কোটার কারণে জনশক্তি রপ্তানিতে এই বৃদ্ধি হয়েছে। গেল আগস্ট মাসে দেশটিতে ৪৬,১০৫ জন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন।
যদিও নতুন কোনো কোটা মঞ্জুর না হওয়ায় আগামী মাসে জনশক্তি রপ্তানির এই ধারা বজায় থাকবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শ্রম নিয়োগকারীরা।
তাদের মতে, বাংলাদেশের দিক থেকে বিলম্ব হওয়ায় সৌদি আরবে স্বাভাবিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
যে কারণে বিপরীত পরিসংখ্যান
এদিকে, আগের মাসের তুলনায় আগস্টে দেশের অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১৮.৭৮ শতাংশ, যা বিগত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া, বছর হিসেবে (ইয়ার-অন-ইয়ার) গেল আগস্টে এই রেমিট্যান্স হ্রাসের পরিমাণ প্রায় ২১.৫৭ শতাংশ।
ব্যাংকার এবং বিশেষজ্ঞরা রেমিট্যান্স কমার জন্য খোলা বাজারে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার উচ্চ বিনিময় হারকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, 'হুন্ডি' এর মতো অনানুষ্ঠানিক মানি-ট্রান্সফার চ্যানেলের দিকে প্রবাসীরা আকৃষ্ট হওয়ায় এমনটি ঘটছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)-এর মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অনেক প্রবাসী অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠান, কারণ আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করলে কম টাকা পান তারা। এছাড়া, ব্যাংকে যাওয়া-আসায় তাদের কিছুটা সময়ও নষ্ট হয়।"
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বর্তমান এই ধারা বজায় থাকবে কিনা সে বিষয়ে নিজের উদ্বেগ তুলে ধরে আলী হায়দার আরও বলেন, "বর্তমানে যারা মালয়েশিয়া যাচ্ছেন, তাদের আগে থেকেই একটি পূর্ব-অনুমোদিত কোটা ছিল; কিন্তু এখন মালয়েশিয়া বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের জন্য নতুন কোনো কোটা মঞ্জুর করেনি।"
বায়রা মহাসচিব উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় (প্রায় তিন মাস) সৌদি নিয়োগকর্তারা তাদের বিদেশি কর্মীর চাহিদা পূরণে পার্শ্ববর্তী নেপাল ও ভারতের মতো দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে।
মালয়েশিয়ায় কোটা
প্রায় সাড়ে তিন বছর বিরতির পর, ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে আবারও শ্রমিক নিয়োগের জন্য ঢাকার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে মালয়েশিয়া।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগ এ পর্যন্ত ৪.৫৭ লাখ নতুন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, যারমধ্যে প্রায় ৩ লাখ কর্মী ইতিমধ্যেই মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন।
সেক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে– উৎপাদন, নির্মাণ, পরিষেবা, কৃষি, খনি এবং গৃহস্থালী পরিষেবার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্র। অনুমোদন দেওয়া বাকি ১.২৭ লাখ কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন আশা করছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রায় আরও ৫ লাখ নতুন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ পাবে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ধারা
চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ৮ লাখ ৮২ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। তাদের মধ্যে, সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি কর্মী, যা মোট সংখ্যার ৩৫ শতাংশ। এরপরে রয়েছে মালয়েশিয়া (৩০ শতাংশ), ওমান (১১ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৮ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৪ শতাংশ), কুয়েত (৩ শতাংশ) এবং কাতার (৩ শতাংশ)।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি শ্রমিকদের নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং গৃহপরিচারিকা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ড্রাইভার, ইলেকট্রিশিয়ান এবং প্লাম্বার হিসেবেও কিছু সংখ্যক স্বল্পদক্ষ কর্মী নিয়োগ দেয় দেশগুলো।
এছাড়া, ইতালিতে ইতোমধ্যে ১৩ হাজারের বেশি, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৫ হাজার এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ৪ হাজার কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন।
তবে এ সত্ত্বেও বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে এখনও কম বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিকের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেওয়া দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে।
২০২১ সালে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট শ্রম অভিবাসনের ২১.৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ১৭.৭৬ শতাংশে নেমে আসে।
যদিও প্রতিবেদন অনুসারে, স্বল্পদক্ষ কর্মীদের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য তেমন পরিবর্তন আসেনি। ২০২২ সালে এ ধরনের শ্রম অভিবাসনের সংখ্যা ছিল ৩.২৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৩.২৮ শতাংশ।
করোনা মহামারির বিধিনিষেধের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় সম্পূর্ণ থেমে গেলেও ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এই প্রবণতা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
তখন থেকেই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
মহামারি শুরুর আগে, দেশ থেকে প্রতিমাসে গড়ে ৬০,০০০-৭০,০০০ কর্মী বিদেশে পাড়ি দিতেন।
বাংলাদেশ গত বছর রেকর্ড ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে।