এ বছর ইতালিতে রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ, ৮০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয়
দক্ষিণ এশিয়া থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দেওয়া লোকেদের কাছে ইউরোপের ইতালি অন্যতম লাভজনক একটি গন্তব্য। চলতি বছরে বাংলাদেশ থেকে ইতালির কৃষি, হসপিটালিটি এবং উৎপাদন খাতে রেকর্ড সংখ্যক কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইতালির বিভিন্ন কর্মখাতে প্রায় ১৪,৪৩৪ জন কর্মী নিযুক্ত হয়েছেন, যা এক বছরে সর্বোচ্চ।
২০২৩ সালে বাংলাদেশসহ ৩৩টি নন-ইইউ দেশ থেকে মোট ৮২,৭০৫ জন কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন ভূমধ্যসাগরীয় এই দেশটিতে।
এরমধ্যে সিজনাল বা মৌসুমী কর্মীরা সাধারণত কৃষি বা হসপিটালিটি খাতে নিযুক্ত হয়েছেন; অন্যদিকে বাকিরা নিযুক্ত হয়েছেন গৃহকর্ম, শিপ ব্রেকার, সেলসম্যান, নার্স, ইলেকট্রিশিয়ান, ল্যাব টেকনিশিয়ান, ড্রাইভার, ক্লিনার, ওয়েল্ডার, নির্মাণ কর্মী, প্লাম্বার এবং কেয়ারটেকারের কাজের মতো পদগুলোতে।
শিল্পের সংশ্লিষ্টদের মতে, এভাবে বৈধ অভিবাসনের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে অভিবাসন অনুসন্ধানকারীদের সংখ্যা কমে আসবে।
ইতালির রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (শ্রম) আসিফ আনাম সিদ্দিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "একদিকে পরিশ্রমী হিসেবে বাংলাদেশি কৰ্মীদের যেমন সুনাম আছে, অন্যদিকে তারা বিদেশে এ ধরনের চাকরির সুযোগ খুব দ্রুত ক্যাচ করতে পারে। ইতালিতে ইতোমধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছে; নতুন কর্মী আনয়নেও তারা বড় ভূমিকা রাখবে।"
ইতালিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা চলতি ২০২৩ সালের প্রথম ৮ মাসে ৮০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন।
উচ্চ খরচের অভিযোগ
এদিকে কর্মীদের অভিযোগ, অভিবাসনের জন্য তাদের অনেককে ১৫ লাখেরও বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে, যেখানে এই খরচ ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
আসিফ আনাম সিদ্দিক বলেন, "ইতালীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অভিবাসনের জন্য খরচের কোনো নির্দেশনা নেই। সরকারি রাজস্ব স্ট্যাম্প হিসেবে শুধু ১৬ ইউরো খরচ করতে হয়। সেইসঙ্গে, ভিসা আবেদন খরচ এবং বিমান ভাড়া বহন করতে হয় আবেদনকারীকেই।"
তবে অভিযোগ স্বীকার করে এই কূটনীতিক ব্যাখ্যা করেন, "আগত কর্মীদের সঙ্গে যখন আমাদের কথা হয়, তখন তারা আন-অফিসিয়ালি এ বিষয়ে আমাদের জানিয়েছেন। মূলত যেসব কর্মী আসবেন, তাদেরকে চেনেন এমন কারো রেফারেন্স দিতে হয় নিয়োগকর্তাদের কাছে।"
"এই থার্ড পার্টি এনগেজমেন্টের সুযোগের কারণেই একটি চক্র বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয় নিচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান টিবিএসকে বলেন, বেশ কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি ইতালিতে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত। তবে অভিবাসনের জন্য উচ্চ খরচের ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
ভিসার ধরন
সিজনাল ওয়ার্কার প্রোগ্রামের আওতায়, একজন কর্মীকে কৃষি বা হস্পিটালিটি খাতে কাজ করার জন্য ইতালিতে এক মৌসুমে ৬-৯ মাস থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।
তবে বাংলাদেশি খামার কর্মীরা প্রায় প্রতি মৌসুম শেষেই দেশে না ফিরে ওই কর্মসূচির শর্ত লঙ্ঘন করে। এতে ২০১২ সালে বাংলাদেশিদের জন্য সেদেশে যাওয়ার বিশেষাধিকার সীমাবদ্ধ করে দেয় ইতালি।
যে সব কর্মীদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে– তাদের অধিকাংশেরই দাবি, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যে পরিমাণ অর্থ তারা দিয়েছেন, এত অল্প সময়ে সে পরিমাণ বা পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করতে পারেননি তারা।
২০২০ সালের ১২ অক্টোবর ইতালির 'ডিক্রেটো ফ্লুসি'-তে তালিকাভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশি সিজনাল কর্মীদের ইতালি যাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়। 'ডিক্রেটো ফ্লুসি' হলো প্রতি বছর ইতালি কর্তৃক জারিকৃত একটি নির্দিষ্ট কোটা, যা দেশটিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বহির্ভুত দেশের নাগরিকদের ইতালিতে গিয়ে কাজ করার অনুমতি দেয়।
এ বছর ইইউ বহির্ভুত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ৪৪,০০০ সিজনাল ভিসা দেওয়া হয়েছে, আর বাকি ৩৮,৭০৫টি ভিসা দেওয়া হয়েছে সিজনাল নয় এমন কর্মীদের জন্য। এ ধরনের ভিসার মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
যেভাবে ইতালিতে যাবেন কর্মীরা
চলতি ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইতালীয় কর্তৃপক্ষ প্রাপ্ত আবেদনগুলো বাছাইয়ের মাধ্যমে যোগ্য কর্মীদের নিয়োগ দানের জন্য নির্বাচিত করবে।
ইতালির নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুযায়ী, একজন নিয়োগকর্তা নির্দিষ্ট ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার করে স্থানীয় ডিসি অফিস থেকে একটি অনাপত্তি শংসাপত্রের (এনওসি যা নুল্লা ওস্তা নামে পরিচিত) জন্য অনুরোধের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি শুরু করবেন।
এনওসিতে প্রার্থীর নাম এবং পাসপোর্ট নম্বর অন্তর্ভুক্ত থাকে। ইস্যু হওয়ার পর এটি বাংলাদেশে সম্ভাব্য কর্মীর কাছে পাঠান নিয়োগকর্তা। এরপর ওই এনওসি সংযুক্ত করে দূতাবাসে ইতালীয় ভিসার জন্য আবেদন করেন ওই সম্ভাব্য কর্মী।
ইতালিতে আসার পর কর্মী ও তার নিয়োগকর্তা স্থানীয় ডিসি অফিসে সরকার-নির্ধারিত ১৬ ইউরো মূল্যের রাজস্ব স্ট্যাম্পসহ একটি কর্মসংস্থান চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
এছাড়া, যারা আবেদন জমা দেওয়ার জন্য হেল্প ডেস্কের সহায়তা নেন, তাদেরকে সর্বোচ্চ ৩০০ ইউরো পর্যন্ত ফি প্রদান করতে হয়; এর বাইরে আবেদনের সঙ্গে অন্যকোনো খরচের সংশ্লিষ্টতা নেই।