মেগা প্রকল্পে সৌদি আরবে বাড়ছে বাংলাদেশি শ্রমিক চাহিদা, তবে কমছে অন্যান্য শ্রমবাজারে
সৌদি আরব গত মাসে ৮৩ হাজার ৭৩৩ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ করেছে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে কোনো একক দেশের জন্য সর্বোচ্চ বৈদেশিক কর্মসংস্থান। দেশটির মেগা প্রকল্পগুলো এ চাহিদা বাড়ানোর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে। এসব প্রকল্প দেশটিতে ভবিষ্যতে আরও বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যদিও সৌদি আরবে কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, অন্যান্য শ্রমবাজারে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা কমেছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে বাংলাদেশ মোট এক লাখ তিন হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে এককভাবে সৌদি আরবেই গেছে ৮১ শতাংশ। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য প্রথাগত শ্রমবাজারে নিয়োগ সামগ্রিকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ঢাকায় এক সাক্ষাৎকারে সৌদি রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসুফ ইসা আল দুহাইলান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তেলসমৃদ্ধ দেশটি এর মেগা প্রকল্প এবং 'ভিশন ২০৩০' উদ্যোগের জন্য বাংলাদেশ থেকে আরও কর্মী নিয়োগ করছে।
'বর্তমানে সৌদি আরবে ৩২ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। আমরা ধীরে ধীরে আরও বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে আসছি। তাদের কর্মদক্ষতা এবং কঠোর পরিশ্রম আমাদের এ সিদ্ধান্তের অন্যতম প্রধান কারণ,' বলেন রাষ্ট্রদূত।
সৌদি আরবের উচ্চাকাঙ্ক্ষী 'ভিশন ২০৩০' উদ্যোগের আওতায় বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যত-ধাঁচের নিওম শহর, লোহিত সাগর প্রকল্প, আমালা এবং ঐতিহাসিক স্থান আলউলার উন্নয়ন। এসব প্রকল্প বিদেশি শ্রমিকদের জন্য বড় চাহিদা তৈরি করেছে।
সংকুচিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শ্রমবাজার
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন এবং জর্ডানের মতো বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, শ্রমিকের অতিরিক্ত সরবরাহ, স্বল্পদক্ষ কর্মীর কম চাহিদা এবং জুন থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে কর্মসংস্থানের সুযোগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। অন্যদিকে বাহরাইন ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ রেখেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ধীরে ধীরে ভিসা দেওয়া কমিয়েছে। দেশটি দক্ষ কর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়া এবং আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ভিসা কমানোর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
২০১৮ সালে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের হাতে একজন ইমাম হত্যার ঘটনার পর বাহরাইন বাংলাদেশি কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং অনেক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠায়।
অন্যদিকে, ভিসা ব্যবসার দরুন শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কারণে গত সেপ্টেম্বর ওমান এটির শ্রমবাজার বন্ধ করে দেয়।
মালয়েশিয়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে মে মাসে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। একই সময়ে কাতার, কুয়েত এবং জর্ডানেও শ্রমিক নিয়োগের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
শ্রম রপ্তানি নিয়ে শ্বেতপত্রের পর্যালোচনা
২ ডিসেম্বর প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রম প্রবাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে: একক বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে মূল গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত দেশগুলো প্রায়ই হঠাৎ করে নিয়োগ বন্ধ করে দেয় বা শ্রমিক নেওয়া কমিয়ে দেয়।
কমিটির সদস্য অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী এ অস্থিতিশীলতার মূল কারণ হিসেবে ভিসা সংগ্রহ প্রক্রিয়ার ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন।
'কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়োগকর্তার সক্ষমতা যাচাই না করেই ভিসা সরবরাহ করে। অনেক ক্ষেত্রে দূতাবাসের কর্মীরাও সঠিকভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করেন না বা এটি করতে নিরুৎসাহিত হন,' বলেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা তাসনীম সিদ্দিকী।
কিছু অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দক্ষ শ্রমিক তৈরির ওপর জোর দিয়ে এবং ইউরোপে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করে বাংলাদেশের সৌদি আরবের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানো উচিত।
তারা পরামর্শ দেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈশ্বিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বন্ধ শ্রমবাজারগুলো পুনরায় চালু করা যেতে পারে।
সৌদিতে উচ্চ কর্মসংস্থান সত্ত্বেও কম রেমিট্যান্স
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও দেশটি থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ২.৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার।
গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩.৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে রেমিট্যান্স প্রেরণকারী শীর্ষ দেশ ছিল, আর সৌদি আরব ৩.২ বিলিয়ন ডলার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল।
যদিও সৌদি আরব এ বছর প্রায় ৬০ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ করেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত মাত্র ৫ শতাংশ কর্মী নিয়োগ করেছে। দেশটি আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে স্বল্প-দক্ষ কর্মীদের নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
বেসরকারি তথ্যানুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন, যা সৌদি আরবের অভিবাসীর সংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, 'সৌদি আরবে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করলেও অনেকেই তথাকথিত ফ্রি ভিসা নিয়ে আসছেন। কিন্তু তারা কাজ খুঁজে না পাওয়ায় রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না।'
তিনি আরও বলেন, 'হুন্ডি চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে, যা বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রভাব ফেলছে।'
এ বিশেষজ্ঞ দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে ইউরোপের নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
শ্বেতপত্র কমিটির সদস্য তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, 'সৌদি আরবে প্রায় ৩০ লাখ অভিবাসী থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের কম মজুরি এবং আকামা [কাজের অনুমতিপত্র] পেতে বিলম্বের কারণে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কম।'
তিনি যোগ করেন, 'আকামার উচ্চ ফি নিয়োগকর্তারা দিতে দ্বিধা করেন। ফলে শ্রমিকদের আকামা পেতে সময় লেগে যায়।'
একজন স্বল্প-দক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে সাধারণত ২৭ হাজার থেকে ৩২ হাজার টাকা আয় করেন, যেখানে মালয়েশিয়ায় ন্যূনতম বেতন প্রায় ৩৮ হাজার টাকা।
ঢাকায় সৌদি রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসুফ ইসা আল দুহাইলান বলেন, 'সৌদি আরবে ৯০ দিনের প্রবেশন সময়ের পরে কর্মীরা ভিসা এবং এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আকামা পান।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি শ্রমিকেরা বেতন না পাওয়া বা আকামার অভাবের সমস্যায় পড়েন, সেক্ষেত্রে তারা আদালতে অভিযোগ করতে পারেন বা তাদের দূতাবাস ও সৌদি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেও সমাধান চাইতে পারেন।'
সৌদি আরবের পর অন্য শীর্ষ বাজার
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় বাজারগুলো হলো মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, কুয়েত ও বাহরাইন।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে ২০২১ সালে চার লাখ ৫৭ হাজার, ২০২২ সালে ছয় লাখ ১২ হাজার, ২০২৩ সালে চার লাখ ৯৭ হাজার এবং এ বছর পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কর্মী গেছেন।
তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চাকরির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। দেশটি ২০২২ সালে এক লাখ এক হাজার, ২০২৩ সালে ৯৮ হাজার এবং এ বছর মাত্র ৪৭ হাজার কর্মী নিয়োগ করেছে।
ওমান ২০২২ সালে এক লাখ ৭৯ হাজার কর্মী নিয়োগ করলেও এ বছর শ্রমবাজার বন্ধের কারণে মাত্র ৩৩৩ জন কর্মী নিয়োগ করেছে।
মালয়েশিয়া গত বছর তিন লাখ ৫০ হাজার কর্মী নিয়োগ করলেও, চলতি বছর তা কমে ৯৩ হাজারে নেমে এসেছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, 'কোনো দেশের মেগা প্রকল্প ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর শ্রমিকের চাহিদা নির্ভর করে, যা সময়ের সঙ্গে ওঠানামা করে।'