আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আশঙ্কার মধ্যেই জুন নাগাদ ৩০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ গঠনের আশা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বেশকিছু শর্তে বাংলাদেশের জন্য ঋণ মঞ্জুর করে। সেগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে ইতোমধ্যেই ঢাকায় এসেছেন সংস্থাটির রিভ্যিউ মিশনের সদস্যরা। কিন্তু, শর্ত অনুযায়ী, নেট রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায়– দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এরমধ্যে সরকার আগামী বছরের জুন নাগাদ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলার প্রক্ষেপণ জানিয়েছে।
বর্তমান ২১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের তুলনায় উচ্চতর এই প্রক্ষেপণ, এই মাসে মরক্কোর মারাকেশ শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় উত্থাপন করা হবে। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার একটি চিত্র তুলে ধরবেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি নথিপত্র দেখে এমনটাই জেনেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
৪.৭ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা প্যাকেজের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে আইএমএফের দেওয়া অন্যতম একটি শর্ত ছিল, ৩০ সেপ্টেম্বর নাগাদ অন্তত ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলারের নেট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ থাকা। কিন্তু, ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে নেট বা প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ২১.১৫ বিলিয়ন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যসূত্রে জানা গেছে।
রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা যায়নি, এই ব্যর্থতার পেছনে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করে সফররত মূল্যায়ন মিশনকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন আর্থিক আমলারা, যাতে নির্ধারিত সময়েই আইএমএফ তাদের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করে।
মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইএমএফের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। ঢাকায় অবস্থানের দ্বিতীয় দিন– সোমবারে রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আবদুর রউফ তালুকদার ও অর্থসচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে বৈঠক করবেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা অবস্থানকালে তারা সরকারের এক ডজনের বেশি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন। মিশন সদস্যরা তাদের রিপোর্ট আইএমএফ'র আঞ্চলিক নির্বাহী পরিচালক ড. কৃষ্ণমূর্তির কাছে হস্তান্তর করবেন। ড. কৃষ্ণমূর্তি নিজেও ১৮ অক্টোবর ঢাকা আসছেন। সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
আইএমএফ রিভ্যিউ মিশন– শর্তগুলো অর্জনে সফলতা-ব্যর্থতা পর্যালোচনা করে আগামী ডিসেম্বর ও ২০২৪ সালের জুনের জন্য নতুন করে আবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেবে।
সোমবার নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, আইএমএফ কর্মকর্তাদের দেওয়া প্রতিবেদন তাদের বোর্ডে উত্থাপন করা হবে। এর ভিত্তিতে তারা আগামী ডিসেম্বরে পরবর্তী কিস্তি ছাড় করা হবে কিনা– সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান একদিন আগেই বলেন যে, নির্বাচনের (ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে) আগে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়, কারণ দেশে ২১ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আছে, আমদানিও ৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির জন্য যেসব শর্ত পূরণ দরকার সেসব আমরা পূরণ করেছি। তাই দ্বিতীয় কিস্তি পেতে কোনো সমস্যা হবে না।'
এদিকে, গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আইএমএফ নির্দেশিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা কম আদায় করেছে। চলতি অর্থবছর জিডিপির অনুপাতে ০.৫% বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে। এ হিসাবে, এবছর ৪.১০ লাখ কোটি টাকা আয় করতে হবে। কিন্তু, অর্থবছরের প্রথম তিনমাসেও ৬১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণেও পিছিয়ে আছে এনবিআর।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সাথে প্রতিষ্ঠানটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আগামী ৫ অক্টোবর। বৈঠকে গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে মন্থর প্রবৃদ্ধির জন্য আমদানি কমে যাওয়ায়- শুল্ক বাবদ রাজস্ব আদায় কম হওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেবেন রাজস্ব কর্মকর্তারা। একইসঙ্গে, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরবেন।
রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি জানিয়ে এবং চলতি অর্থবছরে সম্ভাব্য আদায়ের বিষয়ে গত সপ্তাহে আইএমএফকে একটি চিঠি দিয়েছে এনবিআর। চিঠিতে বলা হয়, এনবিআর আইএমএফ নির্দেশিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আশা করছে। কিন্তু, নিম্ন আমদানি ও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ধীরগতির হয়ে পড়ার কারণে এসব খাত থেকে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ আদায় প্রভাবিত হতে পারে।
এনবিআরের ভ্যাট উইং জানায়, চলতি বছরে আমদানিতে নেতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে, এটি অব্যাহত থাকলে তা রাজস্ব আদায় ব্যাহত করবে।
সূত্রগুলো জানায়, চলমান ডলার সংকট কিছুটা লাঘব হওয়া, কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানিতে স্থিতিশীলতা ফেরা, পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে যথেষ্ট জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত হওয়া ইত্যাদি বিষয় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত।
এনবিআরের সূত্রমতে, মোট ভ্যাট রাজস্বের প্রায় ১০ শতাংশই আদায় করা হয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও সংস্থার ক্রয় কার্যক্রম থেকে। কিন্তু, এবছর বিভিন্ন কোম্পানি ও সরকার তাদের কেনাকাটার বাজেট কমানোয় এ খাত থেকেও আদায় কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
'আগামী বছরেও এই ধারা অব্যাহত থাকলে– চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রত্যাশিত ভ্যাট আদায় সম্ভব নাও হতে পারে'- জানায় সূত্রগুলো।
তবে এনবিআরের পক্ষ থেকে আইএমএফ মিশনের কর্মকর্তাদের বলা হবে, সিগারেটের ওপর কর পুনর্গঠন থেকে চলতি বছর বাড়তি ভ্যাট হিসেবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আদায় হতে পারে। এছাড়া, মোবাইল ফোন, পলিপ্রপেলিন স্টেপল ফাইবার, সফটওয়্যার, এলপিজি সিলিন্ডার এবং ইলেক্টনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি)-র ওপর শুল্ক ও কর সমন্বয়ের মাধ্যমে আরও ৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে, যা চলতি বছরের মোট রাজস্ব আয় বাড়াবে।
আরও বড় রিজার্ভ গঠনের আশা
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় উত্থাপনের জন্য একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে অর্থ বিভাগ। এতে তারা প্রক্ষেপণ করেছে যে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ নাগাদ রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে।
'ম্যাক্রোইকোনমিক পারফর্ম্যান্স অব বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনটি আগামী ৯-১৫ অক্টোবর মরক্কোর মারাকাশ শহরে অনুষ্ঠেয় সংস্থা দুটির হাই-প্রোফাইল যৌথসভায় উপস্থাপন করা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উন্নতির জন্য সরকার সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এরমধ্যে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ও পরিমাণ তদারকি-সহ অন্যান্য তদারকিমূলক পদক্ষেপ রয়েছে।'
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাব-প্রোগ্রাম (এসপি)- ২ এর আওতায় চলতি অর্থবছরে আরও বাজেট সহায়তা লাভের পরিকল্পনা রয়েছে, যা রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করবে।
চলতি অর্থবছরে এডিবি এবং এআইআইবির থেকে ৪০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা বাবদ পাওয়া যাবে। আগামী বছরের জুন নাগাদ বিশ্বব্যাংকের থেকে পাওয়া যাবে আরও ২৫০ মিলিয়ন ডলার। এই ১.০৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা ছাড়াও, সরকার অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের থেকে বাজেট সহায়তা চাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারিসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংকট দেখা দেওয়ার আগে গত কয়েক বছর ধরে বাহ্যিক খাতের শক্তিশালী পারফর্ম্যান্সের সুবাদে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পারদর্শীতা ছিল বেশ সন্তোষজনক।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বাহ্যিক খাত উন্নয়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল– রপ্তানিতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি, চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ধারাবাহিক উন্নতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা এবং প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু, গত অর্থবছরে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ও আমদানি মূল্য পরিশোধের বিপুল চাপ– বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকেও কিছুটা চাপের মধ্যে ফেলেছে, এতে আরো বলা হয়েছে।
এদিকে গত রোববার রেমিট্যান্সের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে দেশে আসা রেমিট্যান্স। রপ্তানি আয়ও পাঁচ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম হয়েছে। এতে দেশের বাহ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় চাপ তৈরির উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
গত অর্থবছরে রেকর্ড ১১.৩ লাখ কর্মী বিদেশে গেলেও, তার বিপরীতে রেমিট্যান্স আয়ে পতনই দেখা যাচ্ছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক ডলারের যে দাম দেয়, তার চেয়ে বেশি দেয় হুন্ডি চক্র। এতে আনুষ্ঠানিক বা বৈধ চ্যানেলে ডলার আসার পরিমাণ কমছে। এটি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকেও জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ডলারের দরে অস্থিতিশীলতা রয়েই গেছে। যা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় উভয়ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানান বিশ্লেষকরা।