রেমিট্যান্স নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সেপ্টেম্বরে কমলো জনশক্তি রপ্তানি
সম্প্রতি দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার উদ্বেগের মধ্যে গেল সেপ্টেম্বরে দেশের জনশক্তি রপ্তানিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দেওয়া কর্মীর সংখ্যা ১,০৭,৫৭৪ জনে নেমে এসেছে, যা গত ৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং গেল আগস্টের চেয়ে ২২.৪২ শতাংশ কম।
এর আগে, সবচেয়ে কম ১,০১,৫৫৮ সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল গত মে মাসে।
মূলত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানি তীব্রভাবে হ্রাস পাওয়ায় সার্বিক এই পতনের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। আগস্টে মালয়েশিয়ায় ৪৬,১০৫ জন কর্মী গেলেও সেপ্টেম্বরে তা নেমে আসে মাত্র ২১,৫২০ জনে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান ৪ গন্তব্য– সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান এবং কাতারেও জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, সৌদি আরবে এই সংখ্যা বেড়েছে সামান্য পরিমাণে।
শ্রম নিয়োগকারীরা মালয়েশিয়ায় শ্রম রপ্তানি কমে যাওয়ায় পেছনে বিএমইটির হস্তক্ষেপেকে দায়ী করেছেন। নতুন কোটা অনুমোদন না হওয়া জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেন তারা।
এদিকে, গত কয়েক মাস ধরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমাগত কমছে। এরমধ্যে বিদেশে শ্রম রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল সেপ্টেম্বরে দেশে মাত্র ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আয় হয়েছে, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম বিরূপভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, "জনশক্তি রপ্তানির জন্য ৭০০ এজেন্সি নিয়োজিত আছে। এরমধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান মিলে একটি সিন্ডিকেট গঠন করেছে। সিন্ডিকেটের প্রভাবে নিয়োগ খাতে স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে।"
আবুল বাশার আরও উল্লেখ করেন, কয়েকটি সংস্থার কাছে বিএমইটির অগ্রাধিকার থাকায় অনেক সংস্থার জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া, সৌদি আরবের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অসদাচরণের সাম্প্রতিক ঘটনায়ও বাংলাদেশি কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়েছেন।
বিএমইটির পরিচালক (অভিবাসন) এম আবদুল হাই জানান, চলতি বছরের শুরু থেকে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে। "আমরা সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে তাদের জনশক্তির বার্ষিক চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রপ্তানি করেছি। ফলস্বরূপ, সেসব দেশে এখন চাহিদা কিছুটা কম রয়েছে। তবে, বছরের শেষ নাগাদ এই চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।"
মালয়েশিয়ায় কোটা
সাড়ে ৩ বছরের বিরতির পর বাংলাদেশ থেকে আবারও কর্মী নেওয়ার জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে মালয়েশিয়া। এ লক্ষ্যে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগ বাংলাদেশ থেকে ৪.৫৭ লাখ নতুন কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ কর্মী ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন।
সেক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে– উৎপাদন, নির্মাণ, পরিষেবা, কৃষি, খনি এবং গৃহস্থালী পরিষেবার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্র। অনুমোদন দেওয়া বাকি ১.২৭ লাখ কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের আশা, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রায় আরও ৫ লাখ নতুন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ পাবে।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরীর মতে, বছরের প্রথম আট মাসে মালয়েশিয়ার বেশিরভাগ কোটা পূরণ হয়ে যাওয়ায় গত মাসে জনশক্তি রপ্তানির সংখ্যা কমেছে।
তিনি বলেন, "জনশক্তি রপ্তানি কাজের চাহিদার ওপর নির্ভর করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাহিদা বাড়লে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। তবে এই সংখ্যা প্রতি মাসে ওঠানামা করে।"
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ধারা
চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৯.৮৯ লাখ কর্মী বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এরমধ্যে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি কর্মী, যা মোট সংখ্যার ৩৫ শতাংশ। এরপরে রয়েছে মালয়েশিয়া (২৯ শতাংশ), ওমান (১১ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৮ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৪ শতাংশ), কুয়েত (৩ শতাংশ) এবং কাতার (৩ শতাংশ)।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি শ্রমিকদের নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং গৃহপরিচারিকা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ড্রাইভার, ইলেকট্রিশিয়ান এবং প্লাম্বার হিসেবেও কিছু সংখ্যক স্বল্পদক্ষ কর্মী নিয়োগ দেয় দেশগুলো।
এছাড়া, ইতালিতে ইতোমধ্যে ১৫,২৪২ জন, যুক্তরাজ্যে ৬,৪৩৪ জন, এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪,২১৮ জন কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন।
তবে এ সত্ত্বেও বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে এখনও কম বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিকের উৎস হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেওয়া দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে।
২০২১ সালে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট শ্রম অভিবাসনের ২১.৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ১৭.৭৬ শতাংশে নেমে আসে।
যদিও প্রতিবেদন অনুসারে, স্বল্পদক্ষ কর্মীদের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য তেমন পরিবর্তন আসেনি। ২০২২ সালে এ ধরনের শ্রম অভিবাসনের সংখ্যা ছিল ৩.২৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৩.২৮ শতাংশ।
করোনা মহামারির বিধিনিষেধের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় সম্পূর্ণ থেমে গেলেও ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এই প্রবণতা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।তখন থেকেই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
মহামারি শুরুর আগে, দেশ থেকে প্রতিমাসে গড়ে ৬০,০০০-৭০,০০০ কর্মী বিদেশে পাড়ি দিতেন।
বাংলাদেশ গত বছর রেকর্ড ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে।