খরচ সাশ্রয়ে ইউয়ান-ভিত্তিক ঋণের পক্ষে বাংলাদেশ
বাংলাদেশকে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিল চীন, ডলার-ভিত্তিক অর্থায়ন লাভের সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে তাতে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলোর মতে, প্রচলিত মার্কিন ডলার-ভিত্তিক ঋণের বিপরীতে চীনের ইউয়ান-ভিত্তিক ঋণের সুবিধা-অসুবিধা পর্যালোচনা করতে মন্ত্রণালয় অনুরোধ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তার ভিত্তিতে এসেছে এ সিদ্ধান্ত।
এ বছরের আগস্টে চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংক প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্সের ক্রেডিট- এ অর্থায়ন করা প্রকল্পগুলোতে নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়। ডলারের অস্থিতিশীল বিনিময় দরের প্রেক্ষাপটে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়, যেকারণে অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।
চীন সরকার সাধারণত দু'ধরনের ঋণ দেয়, এর একটি হলো- মার্কিন ডলারে প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) এবং অপরটি হলো– নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল) বা সরকারিভাবে দেওয়া রেয়াতি ঋণ।
বিশ্ববাজারে ডলারের দুস্প্রাপ্যতা ও তার সাথে উচ্চমূল্য সম্পর্কিত থাকায় – বাংলাদেশকে পিবিসি ঋণ ইউয়ানে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার আবেদন করে চীনের এক্সিম ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে। তাই চীন থেকে ডলারে ঋণ নিলে বাংলাদেশকে প্রায় ৬ শতাংশ হারে সুদ দিতে হতো। সে তুলনায়, ইউয়ানে ঋণের খরচ মাত্র ২.৫ শতাংশ, অর্থাৎ সুদহারের বিবেচনায় এটি বড় সুবিধা।
২৫ অক্টোবরে এক ইউয়ানের বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় দর রয়েছে ১৪ সেন্ট। অর্থাৎ, এক ডলারের বিনিময়ে কেনা যাচ্ছে ৭.৩০ ইউয়ান।
তাছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক তার ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, ইউয়ানে ঋণ নিলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, কারণ এ ধরনের ঋণ সাধারণত চীন থেকে পণ্য কিনতে ব্যবহার করা হয়। চীনের ঋণদাতা ব্যাংক বাংলাদেশে পণ্য সরবরাহকারী যে ব্যাংকের গ্রাহক, তাদের সরাসরি আমদানি মূল্য পরিশোধ করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা আরও ব্যাখ্যা করেন যে, ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে মূল্য পরিশোধ করার ফলে রিজার্ভ বাড়তে পারে, যা এই সিদ্ধান্তের আরও আর্থিক সুফল দেবে বাংলাদেশকে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ সাধারণত মার্কিন ডলারে ঋণ পরিশোধ করে। কিন্তু, চীনের ঋণে সুদহার কম থাকায় রিজার্ভ থেকে ইউয়ান কিনে ঋণ পরিশোধ করলে দেশের অর্থ সাশ্রয় হবে। এতে রিজার্ভ ক্ষয়ও কমবে।
এ অর্থনীতিবিদের বলেন, 'এ ঋণের আওতায় পণ্য আমদানির সময় তার সাথে অন্যান্য দেশের তুলনামূলক দর যাচাই করতে হবে। চীন থেকে কেনা পণ্যের দাম যদি অন্য দেশের তুলনায় কম বা সমান হয় তা আমাদের জন্য ভালো হবে।'
'চীনা ঋণ আমাদের এমন ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে যার মাধ্যমে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ে। যদি এই ঋণের অর্থ অবকাঠামোর পেছনে ব্যয় হয়, তাহলে সেখানে থেকে আমাদের আউটপুট হবে অল্প, যা আমাদের ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করবে।'
ইউয়ানে ঋণ নিলে ভূরাজনৈতিক কোন সমস্যা হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'চায়নার ঋণ যদি রপ্তানি অর্থায়নের জন্য হয়, তাহলে আমি ভূরাজনৈতিক সমস্যা দেখছি না। অবশ্য, যদি এই ঋণ এমন প্রকল্পে দেওয়া হয়– যার মাধ্যমে চায়নার প্রভাব বাড়ে, তাহলে ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ দেখা দিতে পারে।'
এম এ রাজ্জাক আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্কতার সাথে চীনা ঋণের সম্ভাবতা যাচাই-বাছাই করেছে। 'আগামীর প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের এ ঋণ নেওয়ার আগে আমরা যদি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নেই, তাহলেই ভূরাজনৈতিক কোন জটিলতা দেখা দেবে না।'
ইউয়ানে ঋণের বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনায় দেখা যায়, চীনের ঋণ বিধিমালার আওতায় প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের অর্থ দিয়ে ৬৫ শতাংশ নির্মাণ সামগ্রী চীন থেকে এবং ৪০ শতাংশ ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম চীনের বাইরে থেকে কেনা যায়। তবে অন্য দেশ থেকে কিনলেও ইউয়ানেই আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলার দিয়ে ইউয়ান কিনতে হবে। এতে মুদ্রা রূপান্তরের ঝুঁকি আছে এবং তাতে প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয়ও বাড়তে পারে।
মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, চীন থেকে দেশের রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলার। সে তুলনায়, আমদানি ব্যয় প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর এ বাণিজ্য ডলারেই হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে চীন থেকে ইউয়ান পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে যা বলেছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠানো চিঠিতে বলেছে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের উচ্চ পলিসি রেটের কারণে বিশ্বে মার্কিন ডলার-ভিত্তিক ঋণের সুদহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার মার্কিন ডলারের চাহিদা ও যোগানের তুলনায়– নানামুখী চ্যালেঞ্জে রয়েছে। বর্তমানে চীন থেকে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে ঋণ নিলে কম সুদের পাশাপাশি ডলার দিয়ে ইউয়ান কিনে দেশের বিনিময় হারে লাভ হবে। সেক্ষেত্রে চীনের ঋণ ইউয়ানে নেওয়া যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সমর্থনের বিপরীতে যুক্তি দিয়ে বলেছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক– পিপলস ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি) সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ক্রমাগত কমাচ্ছে। যেমন- গত আগস্টে এক বছর মেয়াদি লোন প্রাইম রেট (এলপিআর) ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ৩.৪৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। ফলস্বরূপ; মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইউয়ান আরও দুর্বল হবে।
বাংলাদেশ ইউয়ান-ভিত্তিক ঋণ নেওয়ার পক্ষে কিনা জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, 'আমি এবিষয়ে জানি না।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে ইউইয়ান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) বাস্কেট এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ এর আগে চীন থেকে নেওয়া ইউয়ান-ভিত্তিক ঋণের বিপরীতে ২০১৮-২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৩.৬৬ বিলিয়ন ইউয়ান পরিশোধ করেছে। ফলে ভবিষ্যতে ইউয়ানে নেওয়া ঋণ পরিশোধে কোন সমস্যা নেই।
বাংলাদেশের ইউয়ান ঋণ চিত্র
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশের এপর্যন্ত ১৭ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলারের সমান) ঋণ রয়েছে। এরমধ্যে এর মধ্যে মূল ও সুদসহ ৩.২ বিলিয়ন ইউয়ান পরিশোধ করা হয়েছে।
বর্তমানে চীনা অর্থায়নের ১০টি প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে। এরমধ্যে ৬টি প্রকল্পের অনুকূলে প্রস্তাবিত ৯.৪৯ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার) ঋণ নিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। এসব ঋণ নেওয়া হলে, চীনা মুদ্রায় বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৫.৮৪ বিলিয়ন ইউয়ানে।