কর অব্যাহতি কমাতে কাজ করছে এনবিআর
কর আদায়ে শৃঙ্খলা এনে রাজস্ব বাড়াতে– কর অব্যাহতির বর্তমান পরিস্থিতি ও নীতিসমূহ পর্যালোচনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই পদক্ষেপের ফলে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কর অব্যাহতির কিছু সুবিধা হারাতে পারেন।
কর অব্যাহতির একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইন তৈরির উদ্দেশ্যে গত ২৩ আগস্ট একটি কমিটি গঠন করেছে এনবিআরের কর বিভাগ। এ ধরনের 'অব্যাহতি প্রদানের বিষয়টি যাতে অবাারিত না থাকে, সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখে' কেবলমাত্র যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে এ সুবিধা দেওয়া হবে।
এ প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব বোর্ডের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কমিটিকে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে এবিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি, যাতে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে (কর ব্যবস্থায়) শৃঙ্খলা আনা যায়।'
কর বিভাগ ঢালাও কর অব্যাহতির বর্তমান নীতিমালা কঠোর করতে চাইছে, এবং ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর অব্যাহতির অনুমতি আরও বাছাইকৃতভাবে দিতে চাইছে।
স্থানীয় ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পকে উৎসাহিত করতে কাঁচামাল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও কর অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। যার অপব্যবহার রোধ করতে এর আগে শুল্ক বিভাগের নেওয়া উদ্যোগের সমান্তরালে যায় এ পদক্ষেপ।
নতুন গঠিত কমিটির প্রধান মো. ইকবাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'এটা অনেক বড় একটা কাজ, তাই নির্ধারিত ডেডলাইনের মধ্যে আমরা রিপোর্ট দিতে পারব না। বর্তমানে আমরা সম্পূর্ণ সিস্টেমটা পর্যালোচনা করছি, এটা শেষ করে তারপর প্রতিবেদন জমা দিতে আরও সময় লাগবে।'
কর অব্যাহতির মূল্য
কর ছাড় বিভিন্ন আকারে আসে, যেমনটি অর্থমন্ত্রী তার শেষ বাজেট বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি রেয়াত, ছাড়, অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে করারোপ এবং মোট করযোগ্য আয় গণনা থেকে আয় বাদ দেওয়াকে 'প্রত্যক্ষ করব্যয়' হিসেবে উল্লেখ করেন।
সাম্প্রতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার এ ব্যয় কমাতে চায়। স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় শিল্পের এমন কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে দেওয়া শুল্ক সুবিধাও পর্যালোচনা করে কমানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। মূলত, স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহ দিয়ে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পকে সমর্থন দেওয়ার অংশ হিসেবেই এ পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে করব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা আলোচ্য সময়ের জিডিপি'র ৩.৫৬ শতাংশ।
গত অর্থবছরে এ ব্যয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এসময়ে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' উদ্যোগের আওতায় পাঁচটি খাতকে কর অব্যাহতির আওতায় আনা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি, পোশাক ও টেক্সটাইল, অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ এবং হাইটেক শিল্প সম্মিলিতভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা কর ছাড় পেয়েছে, যা করব্যয় হিসেবেও গণ্য।
এসময়ে মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স ও টেক্সটাইল প্রস্তুতকারক, এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় স্থাপিত শিল্পকে সম্মিলিতভাবে আরও ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তি করদাতারা ৪০ হাজার কোটি টাকার কর অব্যাহতি পেয়েছেন, একই সময়ে কোম্পানিগুলোর জন্য দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের একটি শর্ত হিসেবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের করব্যয়কে সুবিন্যস্ত করার একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছে। বহুপাক্ষিক ঋণদাতাটি ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত জিডিপি অনুযায়ী করের অনুপাত বার্ষিক শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর শর্তও দেয়।
কর সুবিধার অপব্যবহার
কর অব্যাহতির সুবিধা নানানভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে, করজালে এই ফাঁক থাকার বিষয়টি সরকারও স্বীকার করে। এরমধ্যে সমাজ কল্যাণের জন্য যেমন কর ছাড় রয়েছে, তেমনি কালো টাকার মালিকরা ক্ষেত্রবিশেষে হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের মাধ্যমে কর অব্যাহতির সুবিধা নিচ্ছে।
ফিশারিজ সেক্টরে আয় দেখিয়ে হ্রাসকৃত কর হারে কর প্রদানের মাধ্যমে সুবিধা নেওয়া হচ্ছে, অথচ এ ধরণের আয়ের প্রকৃত উৎস নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে।
তবে স্থানীয় শিল্পকে সুবিধা দেওয়া, পিছিয়ে পড়া এলাকায় শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করা, নতুন ধরণের বা হাইটেক শিল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করতেও কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবার অভিযোগ রয়েছে, কোন কোন শিল্প নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে কিংবা অনৈতিক উপায়েও এ ধরণের কর অব্যাহতির সুবিধা নিচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।
১০২ ধরনের খাত পাচ্ছে কর অব্যাহতি
করব্যয় সম্পর্কে গত বুধবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এনবিআর। ১০২টি খাত বর্তমানে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর অব্যাহতি পাওয়ার তথ্য এতে উঠে এসেছে। এর মধ্যে ৪০টি খাতে ব্যক্তি করদাতাদের অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে, বাদবাকীগুলোতে আংশিক বা পুরোপুরি অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে কোম্পানি, শিল্প বা বিনিয়োগের জন্য।
রোববার (৫ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, 'অনেকটা অন্ধভাবে কর ছাড়ের ফলে এনবিআরের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির হচ্ছে, এবং এটি নিয়ে তেমন কোন গবেষণাও হয়নি।'
'এমন নয় যে, আমরা সব ধরণের কর ছাড় বন্ধ করতে চাই; কিন্তু, অযৌক্তিক কর ছাড় বন্ধ করার জন্য এটার পর্যালোচনা দরকার' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিভিন্ন খাতের ট্যাক্স কমানোর জন্য ক্রমাগত চাপ আসতে থাকলে– জিডিপিতে করের অবদান বা ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও বাড়ানোর লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।'
পর্যালোচনাকে সমর্থন করছেন অর্থনীতিবিদরা
ঢালাও কর অব্যাহতি থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরেই আমরা ট্যাক্স এক্সেম্পশনের বিষয়টি পর্যালোচনা করে তা যৌক্তিক করার জন্য বলে আসছি। এই সুবিধা কোন খাত কত পাচ্ছে, কত সময় ধরে পাচ্ছে, তাদের অবদান কী – তা বিবেচনা করে এই সুবিধা দেওয়া উচিত' – উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই পর্যালোচনা যাতে নির্মোহ ও দক্ষতার সঙ্গে করা হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।"
শিল্পোদ্যোক্তারাও কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণকে ইতিবাচক মনে করছেন।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন– বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'অর্থনীতিতে রাখা অবদানের ভিত্তিতে যদি কর অব্যাহতির এই নীতিমালা প্রণীত হয়, তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু, সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কেউ যদি ব্যক্তি পরিচয় বা প্রভাব খাঁটিয়ে এ সুবিধা পায়, এবং যাদের এ ধরনের যোগাযোগ নেই তারা যদি না পায়, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।'
অব্যাহতি প্রদানে যেসব বিষয় বিবেচনায় আসতে পারে:
অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রে নন-অপারেটিং আয়ের ক্ষেত্রগুলো আলাদাভাবে বিবেচনা করা হবে। অব্যাহতি যাতে অবারিত নাহয়, সেটি খেয়াল রাখার পাশাপাশি যাতে অত্যধিক সংকুচিত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে।
এ ছাড়া, অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রে ট্রাস্ট এর কর্মপরিধি ও গঠন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করা, কোম্পানির করদাতারা যেন কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি'র সুবিধার অপব্যবহার না করতে পারে– তা পরীক্ষা করা; এবং যেসব আদেশের (সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ) মেয়াদ শেষ, সেগুলো বাতিলের সম্ভাব্যতাও পরীক্ষা করতে হবে।
সূত্র জানায়, প্রতিবেদন পাওয়ার পর এর ভিত্তিতে এনবিআর অব্যাহতির একটি নীতিমালা তৈরি করবে, যার ভিত্তিতে আগামী বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।