এক সময়ের ব্যবসা-সফল টেক্সটাইল মিলগুলো এখন ধুঁকছে গ্যাস আর অর্ডার স্বল্পতায়
মহামারিকালে ব্যাহত হয় বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল, তবে ২০২১ সালের শেষদিকে যা আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। লকডাউনের কাল শেষে পশ্চিমা ভোক্তারা কেনাকাটা বাড়ান, এতে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পায় নজিরবিহীন কার্যাদেশ। ফলস্বরূপ; ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সহকারে রপ্তানি পৌঁছায় ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলারে, যা ছিল অসাধারণ এক অর্জন।
কিন্তু, অর্থনৈতিক এই চাঙ্গাভাব অচিরেই টেক্সটাইল মিল মালিকদের কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। পোশাক উৎপাদনে অপরিহার্য সুতা ও কাপড়ের (ফেব্রিক) ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে হিমশিম খান তাঁরা।
পোশাক শিল্পে- সুতা ও কাপড়ের বাড়তি চাহিদা এ মেটাতে, মিল মালিকদের একাংশ এ শিল্পে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেন– হয় নতুন মিল স্থাপন, অথবা বিদ্যমান স্থাপনার সক্ষমতা বাড়াতে।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো– পোশাক রপ্তানির কার্যাদেশ ব্যাপকভাবে কমে আসায় – ব্যবসার বিকাশের জন্যে করা এ বিনিয়োগই বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতোন ইউটিলিটি পরিষেবার বিল অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া – এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে সক্ষমতার অর্ধেক নিয়ে চলতে হচ্ছে টেক্সটাইল মিলগুলোকে।
কিন্তু, এটাই মিল মালিকদের দুরবস্থার একমাত্র কারণ নয়।
গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হওয়া, ডলার সংকট, বিরোধীদের চলমান অবরোধ এবং মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কারখানাকে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে।
পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং পশ্চিমা বাজারগুলোয় মূল্যস্ফীতি – যা পোশাক রপ্তানি কার্যাদেশের ওপর কালো ছায়া ফেলছে।
এতে টেক্সটাইল মিলকে ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোও প্রভাবিত হচ্ছে। বর্তমানে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, ফলে ব্যাংকগুলোও ঋণ পুনঃতফসিল করতে বাধ্য হচ্ছে।
বেসরকারি দুটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা জানান, চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে অন্তত পাঁচটি করে টেক্সটাইল মিলের ঋণ পুনঃতফসিল করতে হচ্ছে তাদের। মূলত, এসব ব্যবসা চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থাকার কারণেই সেটা করতে হচ্ছে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ ইশরাক টেক্সটাইল মিলস- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হকের মন্তব্যে ফুটে ওঠে বর্তমান দৃশ্যপটের এক সংক্ষিপ্ত অথচ স্পষ্ট চিত্র। তিনি বলেন, 'দেশের স্পিনিং শিল্পের ইতিহাসে এমন চ্যালেঞ্জিং সময় আমি এর আগে কখনোই দেখিনি।'
এর আগে নতুন বিনিয়োগ থেকে ব্যাপক সুফলের আশা করে, ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১.০৫ লাখ যান্ত্রিক টাকু বা স্পিন্ডেল সক্ষমতার একটি বড় মিল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন ফজলুল হক।
গত মাস তিনেক ধরে এই কারখানা সম্পূর্ণরূপে চালু থাকলেও, দুর্বল চাহিদার কারণে উৎপাদনের শুরুতেই নেই গতি।
নিজ দুরবস্থা তুলে ধরে ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, 'ব্যাংক ঋণের ভার একটা বড় দুশ্চিন্তা। নতুন কারখানায় উৎপাদনের শুরুতেই যে অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছি- সেটা আরেকটা বড় চাপ। বর্তমানে চাহিদার যে মন্দা, সামনের চ্যালেঞ্জগুলোকে তা আরও কঠিন করে তুলছে।'
টেক্সটাইল খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে "বিপর্যয়কর" হিসেবে বর্ণনা করেন ওয়েল ফেব্রিক্সের চেয়ারম্যান ও সিইও সৈয়দ নুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ২০২১ ও ২০২২ সাল টেক্সটাইল মিল মালিকদের সুসময় ছিল। কিন্তু, ২০২৩ সাল যেন টিকে থাকার সংগ্রামের বছর, অনেকে এমন ভবিষ্যতের অনুমান করতে পারেনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) একজন পরিচালক ও মুখপাত্র নুরুল ইসলাম বলেন, 'ব্যাংক আমাদের সংগঠনের সদস্য মিল মালিকদের চিঠি দিচ্ছে। অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সবাই তাতে সফল হচ্ছেন না।'
ম্যান-মেইড ফাইবারের জন্য বিশেষায়িত তার কারখানার গ্যাসের বিল অনেকটাই বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি। যা আগে মাসে ২ কোটি টাকা হলেও, বর্তমানে ৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এ বছরের জানুয়ারিতে সরকার গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ বাড়ায়, ১ মার্চ থেকে কার্যকর হয় নতুন এ দাম। কারখানায় গ্যাসের পেছনে ব্যয় বাড়ার যা প্রধান কারণ।
আউটস্পেস স্পিনিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব হায়দার জানান, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। কিন্তু, উৎপাদনে বাড়তি এই খরচটা তারা বায়ারদের থেকে পাচ্ছেন না।
'গত ১০/১২ দিন ধরে কারখানাগুলো বন্ধ, ব্যাংকও ঋণের সুদে ছাড় দিবে না। কমপ্ল্যায়েন্ট ঋণগ্রহীতাদের জন্য যা খুবই বেদনাদায়ক'- যোগ করেন তিনি।
সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত ছিল অদূরদর্শী
রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে সুতা ও ফেব্রিক সরবরাহ করছে বর্তমানে প্রায় ৪০০ স্পিনিং মিল। এ ছাড়া, স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে আরও ২০০ কারখানা।
বিটিএমএ সূত্রে জানা গেছে, তারপরেও ২০২০ ও ২০২১ সালে আরও অন্তত ১০টি নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ শিল্পের অভ্যন্তরীণরা জানান, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক ডজনের বেশি কারখানা তাদের বিদ্যমান সক্ষমতার সম্প্রসারণ করেছে।
তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানার ব্যবসায় থাকা ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কে এম রেজাউল হাসানাতের মতে, ২০২১ ও ২০২২ সালে নতুন কারখানা গড়ে তোলা ব্যবসায়ীরা বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
তিনি বলেন, 'প্রথম প্রজন্মের ব্যবসাগুলো, হঠাৎ বাড়তি চাহিদার মতোন একটা স্বল্পকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বিনিয়োগ করে। আগামী মাস বা বছরগুলোতে এই চাহিদা কতোটা বজায় থাকবে- সেটা তারা বিবেচনা করেনি। এখন তারা নিজেদের একটা ফাঁদের মধ্যে ফেলেছে, বিনিয়োগ এখন তাদের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে।'
এই অবস্থার দায় ব্যাংকগুলোও এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
হাসানাত মনে করেন, নতুন টেক্সটাইল মিলগুলোতে অর্থায়নের আগে ব্যাংকের উচিত ছিল এসব উদ্যোগের টেকসইতা যাচাই করে দেখা। 'কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের দেশে ব্যাংক কখনোই এ ধরনের পরামর্শ দেয় না'- তিনি উল্লেখ করেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত ব্যাংকের চেয়ে বরং গ্রাহকের ওপর নির্ভর করে। 'যদি আমি ঋণ দিতে অস্বীকার করি, অন্য একটি ব্যাংক এগিয়ে আসবে এবং ঋণ দেবে। আর এটি আমাদের ব্যবসার একটি সহজাত বিষয়।'
তবে ঋণ দেওয়ার আগে খাতটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করার দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
কমছে রপ্তানি
২০২১–২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ যখন প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি অতিক্রম করার মাইলফলক অর্জন করেছিল, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন যে আসন্ন বছরগুলোতে দেশের রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে।
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর পরে সে আশায় জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে।
আগের বছরের ৩৪ শতাংশ থেকে কমে ২০২২–২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশে নেমে এসেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জুলাই–অক্টোবর মেয়াদে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ ছিল।
তবে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, তৈরি পোশাক খাতের উভেন ও নিটওয়্যার উভয়ক্ষেত্রেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য হ্রাস। চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আরএমজি রপ্তানি বেড়েছে কেবল ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে হওয়া প্রবৃদ্ধির প্রায় অর্ধেক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পোশাক পণ্যের মন্থর চাহিদা অব্যাহত থাকায়- ২০২৩ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর) দেশটিতে পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে ৫৭৮ কোটি ডলার হয়েছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য জার্মানিতেও রপ্তানি কমছে।
যদিও নিটওয়্যার রপ্তানি এখনও একটি ইতিবাচক ধারা বজায় রেখেছে, তবে উভেন পোশাক রপ্তানি এ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রায় দুই শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
গ্যাস সংকট বড় বাধা
এ খাতে গ্যাস সংকট একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, নারায়ণগঞ্জ জোনের কারখানাগুলো এতে বেশি সমস্যায় পড়ছে। এ জোনে প্রায় ১০০টি টেক্সটাইল মিল রয়েছে। গ্যাসের জন্য উচ্চমূল্য দিয়েও এসব মিল মারাত্মক গ্যাস সংকটে ভুগছে।
গাজীপুর এবং মাওনা এলাকার টেক্সটাইল মিল মালিকদেরও আক্ষেপ, এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি করেও প্রতিশ্রুত নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ বাস্তবায়িত হয়নি।
তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না পেয়েও- ক্রমবর্ধমান গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা শিল্প মালিকেরা বহন করছেন।
অনেক মিল মালিক জানান, তাদের মিলগুলোর জন্য গ্যাসের চাপ ১০ পিএসআই (পাউন্ডস পার স্কয়ার ইঞ্চি) অনুমোদন থাকলেও- তারা বর্তমানে কেবল ২ পিএসআই-এর মতো পাচ্ছেন। এতে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বিটিএমএ গত বছর বলেছিল, দেশের রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল খাত অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের কারণে তিন মাসে ১.৭৫ বিলিয়ন ডলারের উৎপাদন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ১২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ছিল তিন হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর দৈনিক সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৯১ মিলিয়ন ঘনফুটে।
চাহিদা কমলেও স্থিতিশীল সুতার দাম
একটি ইতিবাচক দিক হলো, চাহিদা কমলেও সুতার দাম স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। মিল মালিকেরা জানান, প্রতি কিলোগ্রাম সুতার বর্তমান মূল্য ৩.১০ ডলার, যা আগের বছর ছিল সাড়ে তিন ডলার। তবে এ বছরের শুরুতে অল্প সময়ের জন্য দাম ২.৯ ডলারে নেমে এসেছিল।
মিল মালিকেরা বলছেন, চাহিদা যদি বেশি থাকত এবং যদি তারা তাদের কারখানাগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে পারতেন, তাহলে সুতার দাম বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি বাড়তে পারত।