অক্টোবরে স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ কমেছে ৩০০ মিলিয়ন, চাপ বেড়েছে ডলারের ওপর
আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের সুদের হার বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ার কারণে অক্টোবরে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ ৩০০ মিলিয়ন ডলার কমেছে, যার চাপ বাড়িয়েছে ডলার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২.১৩ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বর শেষে এটি ছিল ১২.৪৩ বিলিয়ন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণের আউটস্ট্যান্ডিং ছিল ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার। ১০ মাসের ব্যবধানে সেটি প্রায় ৪.২৯ বিলিয়ন ডলার কমেছে। এসব পেমেন্টের মধ্যে ৫২৫ মিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছে ইন্টারেস্ট হিসেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "গত ১০ মাসে আমাদের ফরেক্স রিজার্ভের বড় পতন হয়েছে। এর অন্যতম কারণ প্রাইভেট সেক্টরে শর্ট টার্ম ফরেন লোন কমছে। এসব শর্ট টার্ম লোন নিয়ে আমদানি করা হতো। বর্তমানে আমদানি কমে যাওয়ার কারণেও এসব লোনের চাহিদা কিছুটা কমছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ আছে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলার। অগাস্ট শেষেও এর পরিমাণ ২৩.০৯ বিলিয়ন ছিল। অর্থাৎ, তিন মাসের মধ্যেই রিজার্ভ কমেছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট মো. হাবিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ডলারের ইন্টারেস্ট রেট এখন আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া লোন গ্রহীতারা এক্সচেঞ্জ রেট রিস্কের বিষয়টিও মাথায় রাখছেন। ফলে তারা লোন রিপেমেন্ট বেশি করছেন। যেটি আদতে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং রিজার্ভের উপর চাপ বাড়াচ্ছে।"
স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণের জন্য ৮.৫% এর বেশি সুদ দিতে হয়। বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সর্বাধিক সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) এর সাথে ৩.৫% সুদ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এসওএফআর এখন ৫% এর বেশি। ২০২০ সালে এটি ১% এর কম ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে টাকা অবমূল্যায়ন করা হয়েছে প্রায় ৬%।
তবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, টাকার মান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণার চেয়ে বেশি কমেছে। উদাহরণ দিয়ে তারা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা রেটে ডলার বিক্রি করছে, কিন্তু আমদানিকারকেরা সর্বোচ্চ ১২৮ টাকা রেটে ডলার কিনছেন। এখানেই পার্থক্য ১৭ টাকার বেশি।
টাকার মান এভাবে কমে যাওয়ার কারণে ঋণগ্রহীতাদের বেশি দামে ডলার কিনে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে মান আরো কমে যেতে পারে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন শঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া ঋণ নেওয়ার অন্য খরচও বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তারা জানিয়েছেন, এখন বৈদেশিক ঋণের ইন্টারেস্টের উপর ২০% ট্যাক্স দিতে হয়। এমনিতেই ঋণের ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে গেছে। ট্যাক্সের কারণে আরো অতিরিক্ত ১.৭% যোগ হয়ে নেট ইন্টারেস্ট ১০.২% এর বেশি হয়ে যায়। এতো ইন্টারেস্ট দিয়ে ঋণ নিতে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী নন।
শুধু ঋণের চাহিদাই নয়, ঋণ আগের মতো পাওয়াও যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও এমরানুল হক।
তিনি বলেন, "বিদেশি অনেক ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার লিমিট কমে গেছে। আগে আমরা পুরনো ঋণ পরিশোধ করলে তারা নতুন ঋণ দিত। এখন সেটি হচ্ছে না। অর্থাৎ, আমাদের এভাইলেবল লোন কমে গেছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবরে নতুন ঋণ পাওয়া গেছে ২.০৫ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সুদসহ ২.৪১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছেন।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি আরফান আলী টিবিএসকে বলেন, "আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আমাদের ক্রেডিট রেটিং আগের তুলনায় খারাপ করে দেওয়ায় অনেক বিদেশি ব্যাংক এখন আগের মতো আমাদের লোন দিতে চাচ্ছে না।"
"এছাড়া কিছু ব্যাংক সময়মতো লোনের টাকা ফেরত না দেওয়ায় আমাদের দুর্নাম হয়েছে। ফলে নতুন লোন ডিসবার্স কম হচ্ছে। এছাড়া আমদানি এলসি খোলা কমে আসায় লোনের ডিমান্ডও আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে," বলেন তিনি।