ডলার সংকটে বড় আমদানিকারকদের ওপর নির্ভর করছে দুই-তৃতীয়াংশ এলপিজি কোম্পানি
গুরুতর সংকটে রয়েছে বাংলাদেশের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) খাত। দেশের ৩০টি এলপিজি কোম্পানির মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের পক্ষেই আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার মতোন সাধারণ কাজটিই প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। অথচ, রান্নার গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনেও এর ব্যবহার হচ্ছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের মতে, এর প্রধান কারণ হলো চলমান ডলার সংকট।
আলোচ্য এসব কোম্পানি কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। কারাখানা চালু রাখতে একই খাতের নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির থেকে গ্যাস সরবরাহ কিনতে বাধ্য হচ্ছে তারা।এক্ষেত্রে ওমেরা, বসুন্ধরা, বিএম, ইউনি, যমুনা ও ইউনাইটেডের মতোন কতিপয় কোম্পানির কাছ থেকে কিনছে তারা, যেসব প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণে এলপিজি আমদানি করছে।
পুরো বিষয়টিই এখন হয়ে উঠেছে কমে আসা চলতি মূলধন ঠিক রেখে সম্ভাব্য বিপুল ক্ষতি এড়ানোর। এ যেন ডলার সংকটের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা, যার মাধ্যমে এ খাতের কোম্পানিগুলো প্রতিকূলতা মোকাবিলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে এবং বাজারে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে কারখানা চালু রাখছে।
২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ওমেরা প্রতিমাসে প্রায় ১৫ হাজার টন এলপিজি আমদানি করেছে। শিল্প ও যানবাহনে এ জ্বালানি ব্যবহারকারীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ওমেরা মাসে ২৫ হাজার টন এলপিজি আমদানি করছে। এবং যেসব বটলার ব্র্যান্ড বর্তমানে নিজেরা আমদানি করতে পারছে না তাদের কাছেও সরবরাহ করছে।
অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা ও সেজন্য অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগ করার পরেও নাভানা, জি-গ্যাসসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে কেনার জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এর সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, এক বছর আগেও বাল্ক এলএনজি আমদানি করতো অন্তত ১৮টি কোম্পানি, বর্তমানে এর অর্ধেক সংখ্যকও নিয়মিত আমদানির এলসি খুলতে পারছে না।
যেমন এনার্জিপ্যাকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জি-গ্যাস প্রতি মাসে ৫ হাজার টন বা তারও বেশি এলপিজি আমদানি করতো। কিন্তু, গত তিন মাসে তারা কোনো আমদানি করতে পারেনি।
এনার্জিপ্যাকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন রশিদ বলেন, 'ডলার সংকটের কারণে, আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত দামে কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। মাল্টিমিলিয়ন ডলারের এলসি খুলতেও ব্যাংকগুলো ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ মার্জিন চাইছে।'
রশিদ ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশেরও সভাপতি। তিনি আরও বলেন, "একটি শিল্প যখন ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিচ্ছে, তখন এ ধরনের নজিরবিহীন হারে এলসি মার্জিন দেওয়া আর সাধ্যের মধ্যে থাকে না।"
নিত্য এ পণ্যের ব্যবসা এবং জনপ্রিয় ব্র্যান্ডটিকে টিকিয়ে রাখতে অন্যান্যদের মতোন তাঁর কোম্পানিও বর্তমানে স্থানীয়ভাবে চালান কিনছে। অবশ্য আগে তারা যে পরিমাণে আমদানি করেছে, তার কিছু অংশই এভাবে কিনতে পারছে। ফলে বাজার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত খুচরা মূল্যে বিক্রি করতে হয় এলপিজি ব্যবসার প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ফলে অন্যান্য খাতের প্রতিষ্ঠানের মতোন, তারা তাদের বাড়তি খরচ ভোক্তাদের ওপর পার করে দিতে পারে না।
ডলারের আনুষ্ঠানিক বিনিমর দর এবং আমদানির কয়েক মাস পরে ডলারের যে দামে এলসি নিষ্পত্তি করতে হয়, তারমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবধান থেকে যায়। এলপিজি আমদানিকারকের সিলিন্ডার প্রতি লোকসান কত হবে সেটা এই পার্থক্যের ওপর নির্ভর করে বলে জানান এলপিজি কোম্পানিরগুলোর প্রধান আর্থিক কর্মকর্তারা।
যেমন ডিসেম্বর মাসের জন্য প্রতি কেজি এলপিজির খুচরা বিক্রয়মূল্য ১১৭ টাকা ২ পয়সা নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এক্ষেত্রে ডলারের গড় বিনিময় দর ১১৬ টাকা ৩৯ পয়সা ধরে হিসাব করেছে, এই দরে কোম্পানিগুলো আগের মাসে এলসি নিষ্পত্তি করেছে। তবে এখন আমদানিকারকরা ১২০ টাকার চেয়ে কম দরে ডলার সেভাবে কিনতেই পারছেন না।ওমেরা পেট্রোলিয়ামের হেড অফ ফাইন্যান্স আইতার রহমান বলেন, "বিইআরসি-স্বীকৃত বিনিময় হারের বাইরে প্রতি ডলার কিনতে আমাদের অতিরিক্ত যে টাকা দিতে হয়, তাতে ১২ কেজির প্রতিটি সিলিন্ডারে ১০ থেকে ১২ টাকা করে লস হচ্ছে।"
এদিকে ১২২ টাকা বা তারও বেশি দামে ডলার কিনতে হওয়ায় কোম্পানিগুলোকে সিলিন্ডারপ্রতি প্রায় ৮০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
তাছাড়া, প্রতি ডলারের জন্য বেশি দর দিলেই এলসি খোলার যে সমস্যা, তার সুরাহা হয় না। উচ্চ এলসি মার্জিনের কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে আর্থিকভাবে নিঃশেষিত হতে থাকা কোম্পানিগুলোর অর্থায়নের খরচও বাড়ছে। এমনটাই জানান একটি এলপিজি কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা, তার প্রতিষ্ঠান কয়েক মাস আগে এলপিজি আমদানি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।
যমুনা গ্যাসের পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত বলেন, "আমরা স্থানীয় বাজারে নিজেদের পণ্যের বিক্রয়মূল্য জানি, কিন্তু ছয় মাস পরে এলপিজি কেনার দাম কত হবে তা জানি না।'
এই জটিলতার কারণ এলসি নিষ্পত্তি করা হয় ৬ থেকে ৮ মাস পরে। ইয়াসিন বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়নের ফলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে এলসি নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণে আমদানি আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
আজম জে চৌধুরী বলেন, 'জ্বালানি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সাথে সবশেষ মিটিংয়ে আমরা এই বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগ তুলে ধরেছি।'
এলপিজি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান আর্থিক কর্মকর্তারা জানান, বিইআরসি শুধু কোম্পানিগুলোর নথিভুক্ত খরচকে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচনা করে। অথচ এলসির জন্য ডলার সংগ্রহের অনানুষ্ঠানিক ও অনথিভুক্ত ব্যয় ডলারের আনুষ্ঠানিক দরকে অনেকখানি ছাড়িয়ে যায়। প্রতি ডলারের বিপরীতে আমদানিকারক যদি অনথিভুক্ত অতিরিক্ত দর দেন, কেবল তাহলেই ডলার উদ্বৃত্ত থাকা রপ্তানিকারকদের থেকে কিনে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের জন্য এলসি খুলছে বলে জানান তাঁরা।
আরেকটি এলপিজি কোম্পানির প্রধান বলেন, "২০২২ সালের মে মাস থেকেই আমরা ডলার ও বিনিময় দরের পিছনে ছুটছি– এরমধ্যে মাঝখানের কয়েক মাস যখন ডলারের দর কিছুদিন স্থিতিশীল ছিল– সে সময়টা বাদে। ফলে পুঞ্জিভূত লোকসান ও অর্থায়নের খরচ দুইই বাড়ছে।" তাঁর প্রতিষ্ঠান আগে মাসে ২,৫০০ থেকে ৩ হাজার টন এলপিজি আমদানি করতো, পরে এভাবে টাকা লোকসান আর দিতে না পারায় ব্যাংকে অর্থ পরিশোধের সামর্থ্যও হারায়।
এমনকি বাজারের শীর্ষ কিছু প্রতিষ্ঠানও গত এক বছরে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস আমদানি করতে পারেনি এবং তার ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে।
গত এক বছরে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে চারটি এলপিজি ফার্ম; এবং বর্তমানের অসহনীয় হয়ে ওঠা আর্থিক সংগ্রামের কারণে আরও অনেকেই ক্রেতা খুঁজছে।
প্রায় সম্পূর্ণরূপে আমদানি-নির্ভর বাংলাদেশের এলপিজি খাতের বর্তমান দৃশ্যপট এমন, যেখানে চালু থাকা দুই ডজনের বেশি সক্রিয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রক-সংস্থার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রির জন্য প্রতিযোগিতা করছে।
এলপিজি বিপণনকারীরা জানান, প্রতি মাসে দেশের এলপিজি চাহিদা এক মাস আগেও ছিল ৯০ থেকে ১ লাখ টন, বর্তমানে যা পৌঁছেছে ১ লাখ ২৫ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টনে। এই চাহিদার মধ্যে প্রায় ২০ হাজার টন হলো কারখানা ও মোটরকারের।
দেশের শীর্ষ একটি পোশাক রপ্তানিকারক– ফকির ফ্যাশনস লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আতিক মুনির বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলপিজির খরচ বাড়াচ্ছে, অথচ জাতীয় গ্রিডের গ্যাস সরবরাহের চাপ কম থাকায় এটাই আমাদের একমাত্র উপায়।
কোম্পানিটি আগামী মাস থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলপিজির ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে ডলারের দর বাড়তে থাকায়– স্থানীয় বাজারে এলপিজির দামের অনিশ্চয়তা নিয়ে তারা উদ্বেগে রয়েছে।
যেসব কোম্পানির বৈদেশিক মুদ্রা আয় নেই, টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে আরও বেশি শঙ্কিত, কারণ এতে তাদের জ্বালানি খরচও বাড়বে।
'নির্দিষ্ট দামের' বাজারে অনানুষ্ঠানিকভাবে রান্নার গ্যাসের দর বাড়ানোর ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রায়ই কোম্পানিগুলোর অনথিভুক্ত এসব খরচের প্রতিফলন দেখা যায়। ফলে ১২ কেজির একটি এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে ভোক্তাকে অতিরিক্ত ৫০ থেকে ১৫০ দিতে হয়।