শিগগিরই আসছে অনলাইনে জ্বালানি তেল কেনার সুযোগ!
জ্বালানি তেল কিনতে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষার ঝামেলা এড়িয়ে খুব শিগগিরই অনলাইনে অর্ডার দিতে পারবেন বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর বাসিন্দারা। অর্ডার দিলেই তাঁদের ঠিকানায় পৌঁছে যাবে জ্বালানি তেল। অনলাইনে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও লুব অয়েল বিক্রি এবং হোম ডেলিভারির জন্য সরকার একটি নতুন নীতিমালা অনুমোদন করেছে।
আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে শিল্প কারখানা, বাণিজ্যিক ভবন, সরকারি স্থাপনা, বিপনী বিতানের জেনারেটর, ভারী নির্মাণ যন্ত্রপাতি নতুন নীতিমালায় বিভিন্ন খাতে জ্বালানি তেল সরবরাহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
"ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ পদ্ধতিতে জ্বালানি পণ্য বিক্রয়/ সরবরাহের লক্ষ্যে ডিলার/সরবরাহকারী নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা,২০২৪" – গত ৩ জানুয়ারি এক গ্যাজেট জারির মাধ্যমে প্রকাশ করে জ্বালানি বিভাগ।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রংপুর, কুমিল্লা, নারায়ণ ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকা বা সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় অনলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ সীমাবদ্ধ থাকবে। এর বাইরে কোনো শহর, উপশহর, জেলা, উপজেলা ও মহাসড়কে এ পদ্ধতিতে জ্বালানি তেল বিক্রি করা যাবে না।
এসব এলাকায় সরকার নির্ধারিত দরেই জ্বালানি তেল বিক্রি হবে। তবে নির্ধারিত মূল্যের বাইরে ডেলিভারির দূরত্ব অনুযায়ী সার্ভিস চার্জ দিতে হবে।
ট্যাংকলরি বা জেরিক্যানে করে এসব তেল সরবরাহ করবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানসমূহ। ট্যাংকলরিতে সরবরাহ করা হলে সর্বোচ্চ লিটার প্রতি এক টাকা, আর জেরিক্যানে সরবরাহ করা হলে লিটার প্রতি সর্বোচ্চ দুই টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হবে।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি চাহিদার পরিবর্তন এবং ব্যস্ত সময়সূচীতে মানুষের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা অনলাইনে জ্বালানি সরবরাহের চাহিদা তৈরি করেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ভবনে জ্বালানি তেলের ব্যবহার বাড়ছে। পাশাপাশি প্রাইভেট কারও বাড়ছে। যানবাহনের মালিকরা সময়ের অভাবে অনেকসময় সরাসরি নিজেরা কিনতে পারে না। আবার যাদের দিয়ে তেল সংগ্রহ করে– তাদের প্রতি বিশ্বাস করতে পারে না। তেল কম বা চুরি হয়, এ অভিযোগ বাংলাদেশে আছেই। এই সেবা মাঝখান থেকে এসব অবিশ্বস্ত সরবরাহকারীদের দূর করে সুবিধাজনক সমাধান দেবে।
জ্বালানি সচিব নূরুল আলম টিবিএসকে বলেন, অনলাইনে জ্বালানি বিপণন পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। বাংলাদেশের বিপণন ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি আগে থেকেই অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে, জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে। যাতে গ্রাহকরা সহজে পণ্যটি পেতে পারেন। জ্বালানি বিভাগ আশা করছে, এই উদ্যোগে জ্বালানি তেলের গ্রাহকরা ইতিবাচক সাড়া দেবেন।
নাশকতা বা অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকে প্রায়ই পাম্প থেকে খোলা তেল বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা অর্ডার পদ্ধতি ডিজাইন করেছি। এজন্য গ্রাহককে অ্যাপে বা ওয়েবলিংকে বাধ্যতামূলক নিবন্ধন করে নিতে হবে, এবং কোথায়, কার কাছে পণ্য সরবরাহ হচ্ছে– তারও বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। এতে স্বচ্ছ নজরদারি নিশ্চিত হবে, এবং ঝুঁকিও কমবে।"
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে এ ধরনের পদ্ধতিতে ডিজেল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। দেশটির "ডোর টু ডোর ডেলিভারি অব ডিজেল" শীর্ষক একটি নীতিমালাও রয়েছে। বাংলাদেশের অনলাইন জ্বালানি বিক্রির পদ্ধতিতে– বিদ্যমান এসব নীতিমালার অনুসরণ আছে।
বিপিসির তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ডিজেল বিক্রির ৫.৬৩ শতাংশ বা ৪ লাখ ১৩ হাজার ৫৫০ টন শিল্পখাতে বিক্রি হয়েছে। আর শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ বা ৭১ হাজার ২২৮ টন বিক্রি হয়েছে গৃহস্থালী বা আবাসিক গ্রাহকের কাছে।
শিল্প ও গৃহস্থালি খাতে বিক্রি হওয়া তেলের বেশিরভাগই খোলা পদ্ধতিতে বেচাকেনা হয়ে থাকে। এর বাইরেও 'প্যাক পয়েন্ট ডিলারশিপ' পদ্ধতিতে সারা দেশে জ্বালানি তেল বিক্রি হয়ে থাকে।
বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, প্রধানত শিল্প ও আবাসিক খাতকে মাথায় রেখে নীতিমালাটি তৈরি করা হয়েছে। "দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান দৈনিক ৫০ লিটার থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ না থাকলে– শহরের বেশিরভাগ বাড়িতে জেনারেটর চলে, সেখানেও জ্বালানি তেল দরকার। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ভবনের মালিকদের পাম্প থেকে তেল সংগ্রহ করতে হয়।"
তিনি বলেন, এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে তেল সরবরাহ করার ব্যবস্থা থাকলে তারা উপকৃত হবে। পাশাপাশি অন্যান্য খাতও এ নীতিমালার মাধ্যমে উপকৃত হবে। সেজন্য নীতিমালাটি করা হয়েছে।
নীতিমালাকে স্বাগত জানালেন ব্যবসায়ীরা
জ্বালানি তেলের খুচরা বিক্রয় পদ্ধতি আধুনিকায়নের গুরুত্ব স্বীকার করে, বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাজ্জাদ করিম কাবুল অনলাইন জ্বালানি তেল সরবরাহে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, "গ্রাহকদের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী নতুন বিপণন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করার সময় এসেছে। অনলাইনে জ্বালানি তেল অর্ডারের এই পদ্ধতিটি বেশ সম্ভাবনাময়। তবে নিরাপদ মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি, নির্ভরযোগ্য সরবরাহ অবকাঠামো, নির্ভুল পরিমাপ ও মান নিশ্চিত করার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নীতিমালার সফল বাস্তবায়ন করতে হলে এসব সমস্যা দূর করতে হবে।"
দেশের শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম– দারাজের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস টিবিএসকে বলেন, "গ্রাহকদের প্রয়োজন মেটাতে সরকারের এই উদ্যোগকে আমরা অভিনন্দন জানাই। আমাদের বিশ্বাস, এই উদ্যোগ স্মার্ট বাংলাদেশ- এর বাস্তবায়নকে বেগবান করবে।"
অনলাইন প্লাটফর্মে জ্বালানি তেলের বেচাকেনার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা বিচার করেই 2021 সালে দারাজের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমোদন চাওয়া হয়েছিলো। তখন দেওয়া হয়নি। এখন নীতিমালা হওয়ায় যেসব প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ ও সুযোগ রয়েছে তারা এটি করতে পারবে।
"তবে এটি সফল করতে হলে, সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিমালা মেনে চলার মতোন প্রস্তুতি থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা ডিস্ট্রিবিউটর বা পরিবেশকদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ ব্যবসা চালু করতে পারি। সেক্ষেত্রে, অনলাইনে জ্বালানি বিক্রির এ ধরনের প্রচেষ্টা বা ব্যবসাকে দরকারি সহায়তা দেওয়ার পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে"- যোগ করেন তিনি।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বলেন, "এর ফলে ই-কমার্সে নতুন একটি উইন্ডো চালু হলো। এতে নতুন করে কিছু উদ্যোক্তা ই-কমার্সে অন্তর্ভূক্ত হবে। পাশাপাশি ইতিমধ্যে যারা ই-কমার্স করছেন– তারাও নতুন ধরনের ব্যবসার সুযোগ পাবেন।"
কোন ধরনের কোম্পানিগুলো অনলাইনে জ্বালানি তেল বিক্রি করতে পারবে?
বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল বিক্রি করছে তারা এবং অন্য যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান– এই ব্যবস্থায় বিক্রি ও সরবরাহ করতে পারবে। তবে এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিটি (ডিবিআইডি) নম্বরধারী হতে হবে, এবং আইসিটি বিভাগ বা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে জ্বালানি খাতের সেবা প্রদানের জন্য নিবন্ধিত হতে হবে।
ট্রেড লাইসেন্সে অনলাইন মার্কেটিং বা ই-কমার্স উল্লেখ থাকতে হবে, এবং গত তিন বছরে কমপক্ষে তিন কোটি টাকার বার্ষিক টার্নওভার থাকতে হবে।
এসকল প্রতিষ্ঠানের যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের (আরজেএসসি) নিবন্ধনে পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ১০ লাখ টাকা। পাশাপাশি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ বা ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সদস্য হতে হবে।
এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অ্যাপ বা ওয়েবলিংক, অপারেশনাল সফটওয়্যার ও নিজস্ব লোগো থাকতে হবে। থাকতে হবে নিজস্ব পণ্য পরিবহন ও মজুদের ব্যবস্থা।
অনলাইনে জ্বালানি যেভাবে কিনতে হবে
অনলাইনে জ্বালানি তেল কিনতে হলে, ক্রেতাকে বিপিসি অনুমোদিত কোম্পানির অ্যাপস বা ওয়েবলিংকে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম, এনআইডি নম্বর, ভ্যাট রেজিষ্ট্রেশন নম্বর (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), মোবাইল নম্বর, ডেলিভারি লোকেশনের বিবরণ দিতে হবে। ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল গেটওয়ের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে।