কর্পোরেট কর হ্রাসেও কোম্পানিগুলো সন্তুষ্ট নয় কেন
দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য পরিচিত বাংলাদেশ। আদর্শ পরিস্থিতিতে এই দেশ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হওয়ারই কথা। কিন্তু, বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন অবস্থা, যেখানে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) লক্ষণীয়ভাবে স্বল্প।
সীমিত এই এফডিআই ভবিষ্যতে আরো কমতে পারে, কারণ বোঝাসাদৃশ্য কর কাঠামো ও দেশের অস্থিতিশীল রাজস্ব নীতির কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন বিনিয়োগকারীরা।
তিন বছরে কর্পোরেট করের হার ক্রমশ ৭.৫ শতাংশ কমিয়ে এই বোঝা হ্রাসে সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এসব ব্যবস্থার সম্ভাব্য সুবিধাভোগীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলছেন, কার্যত এগুলো পাচ্ছেন না তাঁরা।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিভিন্ন ব্যয় ডিজঅ্যালাউ হওয়া এবং উৎসে কর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের সুযোগ না থাকার ফলে প্রকৃত করহার বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫০ শতাংশে।
ধরুন একটি কোম্পানির রাজস্ব ১০০ কোটি টাকা, আর প্রকৃত মুনাফা ১৫ কোটি টাকা। এখন ২৭.৫ শতাংশ হ্রাসকৃত কর্পোরেট ট্যাক্স হার অনুসারে, (১৫ টাকা লাভের উপর) কর ৪ টাকা ১২ পয়সা হওয়া উচিত। কিন্তু, যদি পণ্য সরবরাহের উপর ৭ শতাংশের মতো বড় টিডিএস (উৎস থেকে কর্তন) হিসাবে নেওয়া হয়, সেটি পরে সমন্বয়ের কোনও ব্যবস্থা না থাকায়– প্রকৃত করহার বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছে যায়।
বর্তমানে পণ্যের ক্ষেত্রে ট্যাক্স ডিডাকশন এট সোর্স বা টিডিএস ৭ শতাংশ, এবং সেবার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ। এরমধ্যে কিছু আবার ন্যূনতম কর হিসেবে কর্তন করা হচ্ছে। অর্থাৎ কোম্পানির আয় হোক না হোক, ওই কর ফাইনাল সেটেলমেন্ট হিসেবে আর সমন্বয় করা যায় না। ফলে কোনো কোম্পানির আয় নাহলে বা যে পরিমাণ ট্যাক্স কর্তন করা হয়েছে, তার চেয়ে কম হলে তাদের প্রকৃত কর বেড়ে যাচ্ছে।
বিদ্যমান কর আইন রয়্যালটি, প্রমোশন, টেকনিক্যাল সার্ভিসসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে ব্যয়ের সীমা বেঁধে দিয়েছে; যা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
যেমন তাঁরা বলছেন, বর্তমানে কোম্পানিগুলো তাঁদের বার্ষিক আয়ের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ প্রমোশন বা প্রচারে ব্যয় করতে পারে। এর বেশি খরচ হলে তা আয়ে যুক্ত হচ্ছে এবং এর উপর কর হচ্ছে, যা করহার বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কেবল আলোচ্য ক্ষেত্রে নয়, ৪৩টি সেবার ক্ষেত্রে প্রুফ অব সাবমিশন অব রিটার্ন (পিএসআর) দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায়, কোম্পানিগুলো বাধ্য হচ্ছে কর বিভাগের কাজ নিজেরা করতে। আবার এতে কোন ধরণের ব্যত্যয় হলে দ্বিগুণ জরিমানা দেওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে।
বিনিয়োগকারীরা আরও বলেছেন, কাঁচামালের অতি-মূল্যায়নের মাধ্যমে আমদানি কর ধার্য হচ্ছে, এতে কোম্পানিগুলোর কর বোঝা আরো বাড়ছে। এর ফলে বেশি বিপাকে পড়ছে অপেক্ষাকৃত কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে প্রকৃত করহার উচ্চ হওয়ায় যেসব কোম্পানি কমপ্ল্যায়েন্স বা স্থানীয় বিধিবিধান মেনে ব্যবসা করতে চায় তারাই বেশি সমস্যার মধ্যে রয়েছে।
"কেবল বিদেশি বিনিয়োগই নয়, স্থানীয় বিনিয়োগও না বাড়ার পেছনে এটি অন্যতম প্রধান কারণ"- যোগ করেন তিনি।
স্বল্প বিনিয়োগ ও উচ্চ কর্পোরেট ব্যয়ের জন্য কর কর্মকর্তাদের হয়রানিকে আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ড. মনসুর বলেন, "আমার নিজের ট্যাক্স সার্টিফিকেট নিতেই পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আর আমাদের সংগঠন (পিআরআই) এর জন্য কর কর্মকর্তারা পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিলেন। আমরা যখন সেটা দিতে অস্বীকার করি, তখন তাঁরা সাড়ে ৪ কোটি টাকা ট্যাক্স দাবি করেন, যদিও আমরা কোনো ধরনের করফাকির সাথে জড়িত নই।"
এনবিআরের ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট এর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, অনেকেই অতীতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে করফাঁকি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন খরচ বাড়িয়ে দেখিয়ে মুনাফা কম দেখিয়েছে কিংবা লোকসান দেখিয়েছে। সেজন্য এ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা অবশ্য স্বীকার করেন যে, এ কারণে কেউ কেউ ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তবে তিনি এও বলেন যে, "পলিসি করা হয় সবার জন্য, একজনের জন্য তো আর করা যায় না।"
সব ধরনের কর সুবিধা ও প্রণোদনা হিসাব করার পরে একটি কোম্পানি যে পরিমাণ কর প্রদান করে সেটিই হচ্ছে তাদের প্রকৃত করহার। এটি সংবিধিবদ্ধ করহারের মতো নয়, কোম্পানিগুলোকে বা বাধ্যতামূলক ন্যূনতম হারে দিতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাথে প্রাক-বাজেট এক সভায় ব্যবসায়ী নেতারা বলেছিলেন, কর্পোরেট করহার হ্রাস করা হলেও– প্রকৃত করহার কমেনি, উল্টো বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ হয়ে গেছে। উৎসে কর কর্তন (টিডিএস) স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি এবং বিভিন্ন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া এর প্রধান কারণ বলে তাঁরা উল্লেখ করেন।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) এর সভাপতি জাভেদ আখতার টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কম হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ব্যাপক উচ্চ প্রকৃত করহার, কর হিসাবের সময় কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের ব্যয়কে না ধরা এবং উৎসে অতিরিক্ত কর কর্তনের কারণে যা ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।"
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় টিবিএসকে বলেন, "একদিকে (কর্পোরেট করের) ন্যূনতম করহার কমছে, কিন্তু বিভিন্ন ধরনের ব্যয় ডিজঅ্যালাউয়েন্স ও টিডিএস এর কারণে ইফেক্টিভ ট্যাক্স বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে ট্যাক্স কমানোর সুবিধা বিনিয়োগকারীরা নিতে পারছেন না।"
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দিন আহমেদ বলেন, "ট্যাক্স বাড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদে রাজস্বের জন্য লাভ হয় না, বরং ফাঁকি বাড়ে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে ইফেক্টিভ ট্যাক্স রেট বেশি, এটি কমিয়ে আনা উচিত।"
এফডিআই থেকে পিছু হটলো নেসলে
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় প্রকৃত করহার বেড়ে যাওয়ার কারণে নেসলে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটি পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে বলে জানা গেছে।
নেসলে বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব এবং হেড অব লিগ্যাল অ্যান্ড ট্যাক্সেশন দেবব্রত রয় চৌধুরী জানান, প্রকৃত করহারের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা বিনিয়োগ করা বা না করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, "বর্তমানে, কর্পোরেট করের হার ২৭.৫ শতাংশ। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের ডিজঅ্যালাউয়েন্স এর কারণে আমাদের ৫ থেকে ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যাক্স হিসাবে ধরতে হবে।"
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "মিনিমাম ভ্যালুর কারণে (কাস্টমস কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া) সম্পূরক শুল্কসহ আমদানি কর হয়ে গেছে ৮০০ শতাংশ। নতুন এই করের কারণে আমাদের কিছু বিদেশি বিনিয়োগের পরিকল্পনা পেছাতে হচ্ছে।"
২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে ৩২৫ কোটি ডলার হয়, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ। আগের বছরে এফডিআই এসেছিল ৩৪৪ কোটি ডলার।