চাহিদা কমায় ৬–৮ টাকা কম দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ব্যাংকগুলো
গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত বিগত ১০ দিনে রেমিট্যান্সে এক মার্কিন ডলারের দর ৬ থেকে ৮ টাকা কমেছে। ডলারের দর টানা ২০ মাস ধরে অস্থিতিশীল থাকার পরে ঘটেছে এই ঘটনা। ব্যাংকাররা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রাটির চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধিই এখানে ভূমিকা রেখেছে।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার, রেমিট্যান্সের এক ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৪ থেকে ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। আগের সপ্তাহের ১২০ টাকার মতো উচ্চ দরের চেয়ে যা অনেকেটাই কমেছে।
ফেব্রুয়ারিতে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ২১৬ কোটি ডলার। কিন্তু, রমজান শুরু হওয়ায় এবং সামনে ঈদুল ফিতর থাকায় মার্চ মাসে আরো ৫০ কোটি ডলার বেশি রেমিট্যান্স আসবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল করতে এই প্রবণতা ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা তাঁদের।
সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সে ডলারের দাম কমাকে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-র চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন।
তিনি বলেন, দেশে ডলারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটি ভারসাম্য আসা এই প্রবণতার পেছনে কাজ করছে। ইতোমধ্যেই আমদানিকারকরা রোজার মাসে যেসব পণ্যের বহুল ব্যবহার হয়, সেগুলো মজুদ করে রেখেছেন। ডলারের দাম আরো বাড়বে এমন অনুমান করেও অনেকে ঋণপত্র (এলসি)-র দায় নিষ্পত্তি করেছেন।
আশাবাদ ব্যক্ত করে সিনিয়র এই ব্যাংকার বলেন, "মনে হচ্ছে শঙ্কার কালো মেঘ কেটে গেছে, এবং আশার আলো উঁকি দিচ্ছে।"
তবে (মুদ্রাবাজারে) প্রকৃত স্থিতিশীলতা আসতে আরো ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে দেশে মুদ্রার বিনিময় দর একটি স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যার সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে দ্রুত টাকার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে।
ফলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫/৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। রপ্তানিকারক, আমদানিকারক এবং রেমিট্যান্স প্রেরকদের মতো বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন সত্ত্বেও– ডলারের বিপরীতে টাকার পতন অব্যাহত থাকে। যেমন বর্তমানে রেমিট্যান্সের এক ডলার কেনার দর ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও– অনানুষ্ঠানিক বাজারে ডলারের দাম ১২০ টাকার বেশি হয়ে যাওয়ায় এই দামে কিনতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
২০২২ সালের জুন নাগাদ রেমিট্যান্সে ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ টাকা। ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যা ১১৫ টাকা পর্যন্ত ছিল।
তবে আনুষ্ঠানিক হারের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনায় ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করার পর যে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়— তাতে ওই বছরের অক্টোবরেই রেমিট্যান্সে প্রতি ডলারের দাম ১২২ টাকা বা তারও বেশি হয়ে যায়।
ফলস্বরূপ; রেমিট্যান্সেও নামে ধস। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান মন্তব্য করেন, "২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে দেশের মুদ্রাবাজারের বিনিময় দরে নজিরবিহীন অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ছিল যার অন্যতম কারণ। নির্বাচনের পরে বাজারে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে, তখন সংশ্লিষ্টরাও কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পান।"
যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদের মতে, এখন সার্বিকভাবে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় অনেক ব্যাংকই আর চড়া দামে ডলার কিনছে না। "দাম আরো বাড়বে এই আশায় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ যারা ডলার সঞ্চয় করে রেখেছিলেন, টাকার মূল্য বাড়তে থাকায় তাঁরাও সেসব ডলার বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন।"
মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি হেড সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, চাহিদার তুলনায় দেশে ডলার আসছে বেশি। "দেশের অর্থনীতির জন্য এটা শুভ সংকেত।" উল্লেখ্য, শুধুমাত্র মাস্টারকার্ডের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ২০ শতাংশ আসে।
মার্কিন ডলারের চাহিদা ও জোগানের প্রবণতা
দেশে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে, বর্তমানে যা মাসে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। রপ্তানি আয়ও ঊর্ধ্বমুখী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা তিন মাস ধরে যা ৫০০ কোটি ডলারের বেশি হয়েছে। দেশের মুদ্রা বিনিময়ের বাজারে আস্থা ফেরানোর সহায়ক হয়েছে এসব ঘটনা।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ২১৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। ব্যাংকারদের মতে, ঈদ উপলক্ষে মার্চ শেষে তা ২৫০ কোটি ডলারের বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ঈদের আগে প্রবাসীরাও পরিবারের বিভিন্ন খরচের জন্য বাড়তি অর্থ পাঠান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ হাজার ৫০৮ কোটি ডলার (১৫.০৮) বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় পেয়েছে বাংলাদেশ। এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে যা ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি প্রধান উৎস, রপ্তানি আয়েও রয়েছে ইতিবাচক ধারা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে যা ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি হয়েছে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।
সে তুলনায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ এলসি দায় নিষ্পত্তি করেছে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার।
এছাড়া, এলসি খোলার দিক থেকে এসময়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক আমদানি আদেশ ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে ৩ হাজার ২৯৩ কোটি ডলারে নেমেছে।
@আমদানিকারকরা সাইট এলসি খোলায় কমছে আগামীতে মূল্য পরিশোধের চাপ
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সাইট এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে। এই ঘটনাও মুদ্রার বিনিময় দরের উত্তাপ কমানোর সহায়ক হয়েছে; কারণ আগের মতো সামনের মাসগুলোতেও ডলারের দাম আরো বাড়তে পারে এই উদ্বেগ থেকে ব্যবসায়ীরা তাঁদের আমদানি দায় পরিশোধ করছেন।
বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল করার সহায়ক হয়েছে কারেন্সি সোয়াপ
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি মুদ্রা অদলবদল বা সোয়াপ ব্যবস্থা চালু করেছে। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে ডলারের সঙ্গে টাকার অদলবদল করতে পারছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজার (ফরেক্স মার্কেট) স্থিতিশীল করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
কারেন্সি সোয়াপের আওতায়, ডলারের স্পট রেট অনুযায়ী, ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং স্থানীয় মুদ্রার ওপর তারল্যের চাপ কমানো– মূলত এই দুই উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম অনুযায়ী, ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিতে পারবে বাংলাদেশ। বর্তমানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক ডলার বিক্রির দর (স্পট রেট) হলো ১১০ টাকা। মুদ্রা অদলবদলের ব্যবস্থায় এটিই বেঞ্চমার্ক রেট বা নির্দেশক মূল্য হিসেবে কাজ করবে।
কারেন্সি সোয়াপে অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলো তাদের কাছে থাকা ডলার দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে পারবে। এতে শক্তিশালী হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।
এদিকে ব্যাংকগুলো যখন তাদের ডলার ফেরত নেবে, তাঁদেরকে টাকায় সুদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে সুদহার হবে রেপো রেটের চেয়ে কম, যা মুদ্রা অদলবদলের ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলোকে অংশ নিতে উৎসাহ দেবে। এভাবে তারা স্বল্প-খরচে তারল্যের প্রয়োজন যেমন মেটাতে পারবে, একইসঙ্গে ভূমিকা রাখবে মুদ্রাবাজারে দর স্থিতিশীল করতে।
ভাসমান বিনিময় চালুর উপযুক্ত সময়?
মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি হেড সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, ডলারের চাহিদা কমায়, বিনিময় হারেও তার প্রভাব পড়েছে। এই ঘটনা বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হারের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে।
"বিনিময় হারকে ভাসমান করার এটিই সবচেয়ে সুবিধাজনক সময়"- বলেন তিনি।
তাঁর সাথে একমত পোষণ করে যমুনা ব্যাংকের এমডি মির্জা ইলিয়াস বলেন, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কমায় বিনিময় হারে একটি ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সময় চলে আসছে।