আমদানি নিষ্পত্তিতে ব্যাংকগুলো ডলারের দাম রাখছে ১১৮ টাকা, খোলাবাজারে ১২৫ টাকা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক একদিনে ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়ানোর পর গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ মে) ব্যাংকগুলো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম ১–২ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া একদিনের ব্যবধানে খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেটে) ডলারের দাম বেড়েছে ৭ টাকা।
কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা রেটে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি করেছে। আগেরদিন বুধবার ব্যাংকগুলো গড়ে ১১৬–১১৬.৫ টাকা রেটে এলসি নিষ্পত্তি করেছিল।
বুধবার দেশের ইতিহাসে একদিনে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন করা হয়। এদিন ডলারের দাম বাড়ানো হয় ৭ টাকা। বুধবার 'ক্রলিং পেগ' বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকগুলো বাজারের ওপর নির্ভর করে নিজেদের রেটে ডলার কেনাবেচা করতে পারবে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমদানি নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম কেমন হবে, তা নির্ভর করে একজন গ্রাহকের কেমন ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে, তার ওপর।
তিনি বলেন, 'বুধবার ছোট আমদানিকারকদের আমরা সর্বনিম্ন ১১৫.৫ টাকা রেটে এলসি পেমেন্ট করেছি। আবার বড় অনেক গ্রাহকের কাছে ডলার বিক্রি করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা রেটে। কারণ বড় গ্রাহকের পেমেন্ট নিষ্পত্তি করতে আমাদের বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করতে হয়। ফলে তাদের কাছে ডলার বিক্রি করার ক্ষেত্রে দামও বেশি রাখতে হয়।
'তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণার পর ব্যাংকগুলো আমদানি নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ডলারের দাম বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে।'
খোলাবাজারে ডলারের দাম ১২৫ টাকায়
বৃহস্পতিবার খোলাবাজারে ডলারের দাম এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মানি চেঞ্জাররা। এদিন খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৫ টাকায়, আগেরদিন বিক্রি হয়েছিল ১১৮ টাকায়।
রিপন মিয়া নামে একজন ডলার-বিক্রেতা বলেন, দাম বেড়ে যাওয়ার পরও ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, 'খোলাবাজারে বিক্রেতারা এখন ডলার বিক্রির কিনতে বেশি আগ্রহী। সবাই চাচ্ছে গ্রাহকদের থেকে কম দামে ডলার কিনতে। তবে কোনো ব্যবসায়ীই ১২৫ টাকার এর নিচে বিক্রি করছেন না।'
এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আরও কয়েকদিন থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন রিপন।
'বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১২২ টাকায় ডলার কিনেছেন,' বলেন তিনি।
চিকিৎসার জন্য যাবেন থাইল্যান্ড মাহফুজুর রহমান; বৃহস্পতিবার মতিঝিল এসেছিলেন খুচরা ডলার কিনতে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আগামী রোববার থাইল্যান্ড যাব। আজকে ৫০০ ডলার কিনতে এসেছি। কমপক্ষে ৬টি মানি এক্সচেঞ্জে ঘুরলাম, কিন্তু কেউ ডলার বিক্রি করল না। এখানে এক্সিম ও অগ্রণী ব্যাংকে গেলাম, ভিসা পাসপোর্ট দেখালাম, তারপরও বলল সরাসরি ডলার দেওয়া যাবে না। পরে ইউসিবির এক পরিচিত ব্যাংকারকে ফোন দিলাম; তিনি বললেন অ্যাকাউন্ট না থাকলে সহজে ডলার বিক্রি করতে চায় না ব্যাংক।'
বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, যেসব শাখায় ডলার আছে, তারা খুচরা ডলার বিক্রি করছে। তবে যে-কেউ গেলেই ডলার পাবে না, নিজস্ব ও পরিচিত গ্রাহককেই ডলার দিচ্ছে শাখাগুলো। গতকাল বেশিরভাগ ব্যাংক খুচরায় ডলার বিক্রি করছে ১১৮ টাকায়।
মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের সভাপতি এমএস জামান বলেন, ডলারের দাম বাড়ানোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ভালো হয়েছে। তবে বাজারে এর প্রভাব দেখতে কিছুটা সময় লাগবে।
বিক্রি করতে এসে ডলারের দাম কম দেখে অনেক গ্রাহক ফিরে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো কোনোকিছুর দাম বাড়লে, সেটি আরও বাড়তে পারে ভেবে আমরা বিক্রি করি না। সাধারণ গ্রাহকের ক্ষেত্রে এটা যেমন সত্য, মানি চেঞ্জারদের জন্যও এটি সত্য। ফলে বৃহস্পতিবার বাজারে ডলারের পরিমাণ কম ছিল। তবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'
রেমিট্যান্সের ডলারের দামও বেড়েছে
বৃহস্পতিবার রেমিট্যান্সের ডলারের দামও কিছুটা বেড়েছে মন্তব্য করে আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা জানান, বুধবার ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করেছে সর্বোচ্চ ১১৬.৫০ টাকা রেটে। তবে এরচেয়ে কম দামেও ডলার পাওয়া যাচ্ছিল। তবে বৃহস্পতিবার এসব ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে গড়ে ১১৭ টাকা দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, 'বৃহস্পতিবার সকালের দিকে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের ডলারের রেট ১ টাকার বেশি বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে দিনশেষে ব্যাংকগুলোর বেশি দামে ডলার কেনায় আগ্রহ কম থাকায় এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোও বাধ্য হয়ে রেট কমিয়েছে।'
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়ানোর ফলে বাজারের কী অবস্থা হবে, এটি বুঝতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বৃহস্পতিবার এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের ডলার বেশি দামে বিক্রি করতে চেয়েছিল। তবে দিনশেষে সেটি খুব বেশি বাড়েনি।'
ডলারের দাম বাড়ায় খুশি রপ্তানিকারকরা
ডলারের দাম বাড়ায় সুবিধা পেয়েছেন রপ্তানিকারকরা। এতদিন তারা ডলারের রেট পেতেন সর্বোচ্চ ১১০ টাকা, এখন পাচ্ছেন ১১৭ টাকা।
একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, 'এতদিন বড় রপ্তানিকারকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি রেটে ডলার বিক্রির জন্য আমাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতেন। তাদের অনেকেই বেশি দামে ডলার বিক্রি করতে পারতেন। তবে ছোট রপ্তানিকারকদের সেই দরকষাকষির সুযোগ ছিল না। এখন ডলারের দাম আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়ায়, ছোট রপ্তানিকারকরা বেশি উপকার পাচ্ছেন।'
সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকরা সুবিধা পাবেন। ডলারের দাম বাজারদরের কাছাকাছি আসায় রপ্তানিকারকদের জন্য ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন নাসিম মঞ্জুর। এছাড়া জ্বালানির খরচ বাড়ায় আমদানি ব্যয়ও বাড়বে।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের মূলধনী যন্ত্রপাতির খরচও বেড়ে যাবে। প্রকৃত আয় বাড়তে পারে, তবে উৎপাদনশীলতা তাৎক্ষণিকভাবে বাড়বে না। 'সবমিলিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার খরচ বাড়বে বলে ধারণা করছি।'
ডলারের দাম বাড়ায় সরকারের আমদানি ব্যয় বাড়বে বলেও মন্তব্য করেন এই অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী।