২০২৩ সালে দেশে শীর্ষ ১০ আমদানিকারক কারা? কোন পণ্য আমদানি হয়েছে বেশি?
গেল বছর জ্বালানি আমদানিতে ৬৮,০০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ, যা দেশের মোট আমদানি ব্যয় ৬.২ লাখ কোটি টাকার প্রায় ১১ শতাংশ।
আনুষ্ঠানিক তথ্যমতে— রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন তার নিয়ন্ত্রণাধীন মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে এই জ্বালানি আমদানি করে।
২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমদানি হয়েছে প্রায় ৯১,০০০ কোটি টাকার পণ্য।
তবে ভোগ্যপণ্য আমদানির দিক থেকে সর্বোচ্চ আমদানি ব্যয় পরিশোধ করেছে টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও সিটি গ্রুপ । এছাড়া, কয়লা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামাল আমদানি করে শীর্ষ ১০ এর তালিকায় সর্বনিম্নে রয়েছে মাতারবাড়িতে অবস্থিত কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্তত ২১৫টি দেশ থেকে ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে ৯টি দেশ— চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুর থেকে।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে মেঘনা পেট্রোলিয়াম ২০,৯৩২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের ৩৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৬১ মেট্রিক টন জ্বালানি আমদানি করে।
একই সময়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ২০,১৪০.৬৩ কোটি টাকা মূল্যের ৩২ লাখ ২২ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টন পণ্য, ইস্টার্ন রিফাইনারি ১৪,১৬৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা মূল্যের ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন পণ্য, যমুনা অয়েল কোম্পানি ১২,৫৫৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকার ২০ লাখ ৬৭ হাজার মেট্রিক টন পণ্য, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ ৫,৭৪২ কোটি টাকার ৫ লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন পণ্য, মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৪,০৮৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার ৬ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন, সুপার অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড ৩,৫০৬ কোটি ২৬ লাখ টাকার ৩ লাখ ৪ হাজার মেট্রিক টন পণ্য, সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড ৩,৩৭২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন পণ্য, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৩,৩৩০ কোটি টাকার ৫ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন পণ্য এবং মহেশখালী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ৩,০৪৯ কোটি ২ লাখ টাকার ৪৫ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করে।
দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক টিকে গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান—শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, এবং সুপার অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯,২৪৮ কোটি টাকা মূল্যের ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৪৮৮ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করেছে।
এছাড়া, সিটি গ্রুপের সিটি এডিবল অয়েল এবং সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৬,৭০২ কোটি ৮১ লাখ টাকার ৯ লাখ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করেছে।
আমদানিকারকরা জানান, বাংলাদেশের জ্বালানি খাত পুরোটাই আমদানি নির্ভর। শিল্পায়নের ফলে বাড়ছে বিদ্যুৎ চাহিদা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ডিজেলের বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। ফলে প্রতিবছরই জ্বালানি আমদানির পরিমাণ বাড়ছে।
ডলার সংকটে ২০২২ সালের দিকে অন্যান্য খাতের মতো জ্বালানি খাতেও আমদানি কমেছিল। তবে আমদানি এখন স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরতে শুরু করছে।
মেঘনা গ্রুপের অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, "আমদানি চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে আমদানির পরিমাণও। করোনা পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্য মন্দাসহ নানান সংকটে গত দুই-তিন বছর ধরে আমদানি তেমন বাড়েনি। তবে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।"
২০২৪ সালে ভোগ্যপণ্যের আমদানি আগের তুলনায় বাড়বে বলে জানান তিনি।
ভোগ্যপণ্য খাতের আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, ভোগ্য পণ্যের বেশিরভাগই আমদানি নির্ভর। এরমধ্যে ভোজ্য তেল এবং চিনিও প্রায় শতভাগ আমদানি করতে হয়। এসব কারণে ভোজ্যতেল এবং চিনি বিশেষ করে— র' সুগার আমদানি করছে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ।
বর্তমানে দেশে র' সুগার আমদানি করে এমন প্রতিষ্ঠাগুলো হচ্ছে— মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, আব্দুল মোনেম এবং দেশবন্ধু। এসব প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেলও আমদানি করে। এর পাশাপাশি টিকে গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেল আমদানির সঙ্গে যুক্ত।
র' সুগার আমদানি খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, দেশীয় চিনি শিল্পকে উৎসাহিত করতে র' সুগার আমদানিতে শুল্কারোপ করে সরকার। কিন্তু এরপরও দেশীয় চিনি শিল্প এগোতে পারেনি। প্রতিবছরই দেশীয় চিনির উৎপাদন কমতে থাকে।
চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে দেশীয় কারখানাগুলোতে বার্ষিক চিনির উৎপাদন ৫০ হাজার টনের নিচে চলে এসেছে। এর ফলে চাহিদার প্রায় শতভাগ চিনি এখন আমদানি করে মেটাতে হয়।"
আমদানিনির্ভরতা কমাতে বিকল্প পদক্ষেপের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের
এদিকে, জ্বালানি এবং ভোগ্যপণ্যে শতভাগ আমদানি নির্ভরতা কমাতে বিকল্প উপায় নিয়ে পরিকল্পনার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, শতভাগ আমদানি নির্ভরতায় যেকোনো সময় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনার সময় সাপ্লাই চেইনে বিপর্যয়ের সময় এই চিত্র দেখা গেছে।
তাই দ্য ইনস্টিটিউট অফ কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) প্রেসিডেন্ট ড. মো. সেলিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "ভোজ্য তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশে তৈল জাতীয় বীজের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার যেমন সাশ্রয় হবে। একই সাথে জ্বালানি খাতে আমদানি কমানোর উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।"
বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার, বিশেষ করে– সৌর বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এই খাতে আমদানি কমানো যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন তিনি।