বাজেটে বিদ্যুৎ ও খাদ্যের জন্য ভর্তুকি বাড়তে পারে ১০ হাজার কোটি টাকা
আন্তর্জাতিক বাজারে সার, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমার পাশাপাশি– রপ্তানিতে প্রণোদনা কমানোর পরিকল্পনা সত্ত্বেও মূলত বিদ্যুৎ ও খাদ্যখাতের জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে।
অর্থবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভর্তুকি ও প্রণোদনার জন্য ১ লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২.১৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।
আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ভর্তুকি ও প্রণোদনার বড় অংশই বরাদ্দ রাখা হতে পারে বিদ্যুৎ ও কৃষিখাতে। এ দুটি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এলএনজি আমদানি, খাদ্য ভর্তুকি ছাড়াও সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও ভর্তুকি বাড়ছে।
তবে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ বা এলডিসি গ্রাজুয়েশন সামনে রেখে রপ্তানি প্রণোদনায় বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।
আইএমএফ ভর্তুকি প্রত্যাহারের সুপারিশ করলেও সরকার কেন বিদ্যুতে ভর্তুকি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে জানতে চাইলে, অর্থবিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "ভর্তুকি একবারে হঠাৎ করে বাদ দেওয়া যায় না, পর্যায়ক্রমে তা বন্ধ করা উচিত। অন্যথায়, এই ধরনের পদক্ষেপ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।"
তিনি বলেন, ভর্তুকির অনেকটা অপচয় হয়। বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকির অপচয় সবচেয়ে বেশি। এসব অদক্ষতা দূর করতে পারলে ভর্তুকি কমিয়ে আনা সম্ভব। সারের ভর্তুকিতেও বিপুল অপচয় হচ্ছে। কৃষকরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ইউরিয়া ব্যবহার করছে। এতে উৎপাদনও কমছে, মাটি নষ্ট হচ্ছে, ভর্তুকিও বাড়ছে। তাই সারে ভর্তুকি কমানোর সুযোগ আছে।
"ডলারের বিনিময় দর বেড়েছে, তাই আমি মনে করি রেমিট্যান্সে প্রণোদনার আর দরকার নেই। এ ছাড়া, তৈরি পোশাকে রপ্তানি প্রণোদনার ক্ষেত্রে নতুন বাজার ও নতুন পণ্যে প্রণোদনা বহাল রেখে বাকিগুলো কমানো যেতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে রপ্তানি প্রণোদনা কমাচ্ছে, যা যৌক্তিক" - যোগ করেন তিনি।
খাত-ভিত্তিক ভর্তুকি বরাদ্দ, বিদ্যুতে সর্বোচ্চ
বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কয়েক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও – আগামী অর্থবছর এখাতে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের বকেয়াসহ চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর সরকার পরিশোধ করেছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে জানুয়ারি শেষে এখাতে বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমানে বিদ্যুৎখাতে প্রতিমাসে গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। এ হিসাবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আরও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ভর্তুকি যোগ হবে।
বিদ্যুতের বকেয়া বিল পাওয়ার জন্য দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের (আইপিপি) পাশাপাশি ভারতীয় রপ্তানিকারকরা সরকারকে চাপ দিচ্ছে। যার প্রতিক্রিয়ায় সরকার বন্ড জারি করে ইতোমধ্যে ভর্তুকির কিছু অর্থ পরিশোধ করেছে।
ভারতের আদানি গ্রুপের কাছে সরকারের পাঁচ মাসে বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৭০ কোটি ডলার। বকেয়া বিল দ্রুত পাওয়ার জন্য গতকাল বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সভা করেছে গ্রুপটির একটি প্রতিনিধি দল।
এ ছাড়া, প্রায় ১৫০ কোটি রূপি বিল বকেয়া থাকার কারণে ত্রিপুরা সরকার চুক্তির তুলনায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও – বর্তমানে ৯০-১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি আগামী দুই অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ দিয়ে পরিশোধ করা হবে। এজন্য আগামী অর্থবছর থেকে প্রতি তিন মাস পর পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। এই কৌশলের লক্ষ্য হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকির চাপ কমিয়ে আনা।
কর্মকর্তারা জানান, আগামী অর্থবছরের বাজেটে এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দও বেড়ে হবে ৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৬ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসে দাম না বাড়লেও – ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও আগের তুলনায় বাড়তি গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা থেকে এখাতে ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে।
কৃষি ভর্তুকি একই, খাদ্যে বাড়ছে
কৃষিখাতে চলতি অর্থবছরের মতোই আগামী অর্থবছরের বাজেটে ২৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা।
তবে টাকার অভাবে কৃষিখাতের ভর্তুকির বকেয়াও পরিশোধ করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে বিভিন্ন ব্যাংক সার আমদানির এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোকে বন্ড ইস্যু করেছে সরকার।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ ৭ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে। খাদ্য ভর্তুকির আওতায় মূলত সরকারি চাকুরিজীবীদের রেশন সরবরাহ করা হয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৬ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা।
সরকার বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল, দাতব্য সংস্থা, গবেষণা সংস্থা ও এনজিওসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বাজেট থেকে অনুদান হিসেবে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে, যা ভর্তুকি হিসেবে দেখানো হয়। আগামী অর্থবছর এখাতে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ভর্তুকি মূল্যে এক কোটি পরিবারকে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে। খোলাবাজারে চাল ও আটা বিক্রি (ওএমএস)সহ অন্যান্যখাতে বরাদ্দের অর্থ ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করে সরকার। আগামী অর্থবছর এসবখাতে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে।
জুনের প্রথম সপ্তাহে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা দেবে সরকার। যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে ৬.৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ধরা হবে ৬.৫ শতাংশ। যদিও বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।
সকল প্রণোদনায় বরাদ্দ কমতে পারে
২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশন হতে পারে, তখন থেকে রপ্তানিতে কোনো প্রণোদনা দিতে পারবে না সরকার। তখন হঠাৎ করে রপ্তানি প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হলে শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিবর্তন মোকাবিলায় রপ্তানি খাতকে প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার ইতোমধ্যেই চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্নখাতে রপ্তানি প্রণোদনার হার কমিয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও বিভিন্নখাতে প্রণোদনা কমানো হবে।
বাজেটে রপ্তানি প্রণোদনা হিসেবে অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও এখাতে ব্যয় কতো হবে, তা নির্ভর করবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ওপর। প্রবৃদ্ধি বাড়লে প্রণোদনায় ব্যয়ও বাড়ে।
২০২২-২৩ অর্থবছর রপ্তানি প্রণোদনায় বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ২৫ কোটি টাকা। যা কমিয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। কর্মকর্তারা জানান, আগামী অর্থবছর এখাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।
এর বাইরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা হিসেবে ১,২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে।
প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী করতে সরকার ২.৫% হারে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এজন্য আগামী বাজেটে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও এখাতে সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রয়েছে।