ডিসেম্বর নাগাদ কমতে পারে মূল্যস্ফীতি: অর্থমন্ত্রী
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকা মূল্যস্ফীতি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত বাজেটের বাইরে আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সরকার তা বিবেচনা করছে।
শুক্রবার (৭ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিনিময় হারের অস্থিরতা, উচ্চ সুদহার ও জ্বালানি ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত যাতে স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে পারে, সেজন্য প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
মন্ত্রী বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন। বাজেটে মূল্যস্ফীতি এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে সাড়ে ৬ এবং ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ ধরা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে আবুল হাসান বলেন, 'আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যখন আমরা [আওয়ামী লীগ] ২০১০ সালে ক্ষমতায় এসেছিলাম, তখন মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি ছিল। কিন্তু আমরা সফলভাবে দুবছরের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। আমি নিশ্চিত, আমরা এবার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, তাতে আগামীতে মূল্যস্ফীতি কমবে।'
মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয় (ওএমএস) এবং ফ্যামিলি কার্ডসহ যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান রয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলোর পরিসর আরও বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
বিদ্যমান আইন সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ কবে নাগাদ কার্যকর করা হবে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার কথা জানাননি অর্থমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান আসন্ন অর্থবছরের বাজেটকে 'সু-সমন্বিত বাজেট' হিসেবে অভিহিত করেন।
'আমি অনেক বছর ধরে অর্থনীতির বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত। এত বছরের অভিজ্ঞতায় আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সু-সমন্বিত বাজেট বলে আমার মনে হয়েছে। এবারের বাজেট বক্তব্যে সবকিছু পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা আগে কখনও হয়নি,' বলেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ নেবে — এমন প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'দেখা যাক। সময় হোক, তখন দেখা যাবে।'
তবে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে ডলারের বিপরীতে টাকা স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
'অন্যদিকে অফশোর ব্যাংকিং আইনের আওতায় প্রবাসী ও বিদেশিরা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে বিদেশি মুদ্রায় আমানত রাখতে শুরু করায় আগামী অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৩২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে,' তিনি আরও বলেন।
বাড়তে পারে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা
প্রস্তাবিত বাজেটে ওএমএস-এর জন্য বরাদ্দ যথেষ্ট কম। সীমিত আয়ের প্রায় এক কোটি পরিবার ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওএমএসের মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে চাল এবং ভোজ্যতেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করে।
বাজেটে কম ওএমএস বরাদ্দ নিয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ও অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার উত্তর দেন।
ওএমএসে বাড়তি পণ্য যুক্ত করার বিষয়ে বাজেটে কোনো বরাদ্দ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, 'অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে মিলে আমরা একটি পরিকল্পনা তৈরি করছি। পরিকল্পনাটি সঠিকভাবে প্রণয়ন করতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে তা বাস্তবায়ন করা হবে। টিসিবির পণ্য বিক্রির জন্য পৃথক দোকান স্থাপন করা হবে। সেখানে এখনকার মতো ভর্তুকিমূল্যে কার্ডধারীদের কাছে নির্ধারিত পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যে আরও পণ্য বিক্রি করা হবে।'
মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'এবারও ওএমএস-এর আওতা সম্প্রসারণ করতে বরাদ্দের চেয়ে বাড়তি অর্থ দিয়েছি। প্রয়োজনে আরও বরাদ্দ দেওয়া হবে।'
তিনি বলেন, 'টিসিবির এক কোটি কার্ডধারীদের বাইরেও এ বছর ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী অর্থবছরও প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।'
মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির পূর্বাভাস
চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটেও মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করে সংকোচনমুলক মুদ্রানীতি ও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থবছরের প্রথম ছয়মাস আ. হ. ম. মোস্তফা কামাল ও পরের ছয়মাস আবুল হাসান মাহমুদ আলী তা বাস্তবায়ন করলেও মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের ঘরেই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৫ শতাংশ। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে এটি আরও অনেক কম।
এ ভিন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থসচিব বলেন, 'মূল্যস্ফীতির হিসাব করার ক্ষেত্রে কোনোরকম হেরফের করার সুযোগ নেই। যেসব ইনপুটের ভিত্তিতে বিবিএস মূল্যস্ফীতির হিসাব করে, সেগুলো সময়মত হালনাগাদ করা হয়। তাই এক্ষেত্রে কোনো সংশয় থাকা যৌক্তিক নয়।'
অর্থমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, নতুন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি যাতে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও মনোযোগী হবেন তিনি।
'টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উন্নয়ন, ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে,' বলেন তিনি।
সরকারের ব্যাংকঋণ মূল্যস্ফীতি বাড়াবে না
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলেও তা মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটে প্রভাব ফেলবে না। ব্যাংক থেকে স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর মেনে সব দেশই ঋণ নেয়। আমরাও নেব। এতে মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।'
অর্থসচিব আরও বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে নেওয়া ব্যাংকঋণের সঙ্গে ব্যাংকখাতের তারল্য সংকটের কোনো সম্পর্ক নেই।
দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী ধারার বেশকিছু ব্যাংকের চলতি হিসাব ঋণাত্মক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী এসব ব্যাংকের ঋণদান কর্মসূচি বন্ধ থাকার কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করছে।
কেন জানতে চাইলে মসিউর রহমান বলেন, 'জনগণ ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা করছে। ব্যাংক তাদের সুদ দিচ্ছে। সেই টাকা ঋণ না দিতে পারলে ব্যাংকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এটা সরকারের কাম্য নয়।'
'ব্যাংকখাতে যে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, তা একদিনে হয়নি। ব্যাংকের দূর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণে খেলাপি বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম না চললে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে,' তিনি আরও বলেন।
'কালো টাকা দেশে থাকে না, বিদেশে পাচার হয়'
প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, 'যারা কালো টাকা তৈরি করেন, তারা সেগুলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাখেন না। কালো টাকা বিদেশে পাচার করা হয়।'
'বিভিন্ন কারণে অনেকে বৈধ সম্পদ রিটার্নে দেখাতে পারেননি। জমি ক্রয়-বিক্রয়ে কিছু টাকা অপ্রদর্শিত হয়ে যায়। আবার ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে যে, অডিটের কারণে তারা তাদের কিছু সম্পদ বৈধ করতে পারছেন না। এসব কারণে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা হয়ে যে সিদ্ধান্ত আসবে, তা-ই করা হবে,' তিনি বলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, দেশে কালো অর্থনীতির আকার জানা নেই এবং এটি এনবিআরের আওতাভুক্ত নয়।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের 'অবৈধ সম্পদ' বৈধ করার সুযোগ নেই বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, 'তার বিষয়ে দুদক তদন্ত করছে এবং এটি ফৌজদারী আইনের বিষয়।'
রাজস্ব বাড়ানো অগ্রাধিকার
'শূন্য করে'র দিন শেষ হয়ে আসছে উল্লেখ করে এনবিআর-প্রধান বলেন, 'আমাদের কর আহরণ বাড়াতে হবে। আমরা কোনো কিছুতেই শূন্য কর দেখতে চাই না। তাই নতুন অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।'
অর্থ সচিব বলেন, এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে অর্থ বিভাগ এক মাসের মধ্যে কাস্টমস জনবল বাড়ানোর অনুমোদন দেবে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার না কমিয়ে অ-তালিকাভূক্তগুলোর করহার কমানো প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, 'কর কমিয়ে রেখে পুঁজিবাজারকে কতোটা কার্যকর করা যাবে, তা আমি জানি না। অনেক দিন কর কমিয়ে রাখা হয়েছিল, তখন কি বাজার ভালো করেছিল? পুঁজিবাজারের আসল সমস্যা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা উন্নত দেশ হতে চাই, তাই আমাদেরকে কর আহরণ বাড়াতে হবে।'
সংবাদ সম্মেলনে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মে. মাহবুব হোসেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।