প্রস্তাবিত বাজেটে আইএমএফ, অলিগার্ক ও আমলাতন্ত্রের কথা রাখা হয়েছে: হোসেন জিল্লুর
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, এবারের বাজেট প্রণয়নে অর্থমন্ত্রী অলিগার্ক বা লুটেরা গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন। যারা ক্ষমতার প্রশ্রয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তাদের কথা চিন্তা করেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার এই বিশেষ শ্রেণির কথা চিন্তা করে অর্থনীতিতে সংস্কার ও ব্যাংক খাত নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয়নি।
তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা 'কাগুজে'। কারণ এই বাজেটে উদ্যোগের কমতি নেই। কিন্তু সেগুলো অসম্পূর্ণ ও গা-ছাড়া। একইসাথে খুবই স্বাভাবিক। সংকট উত্তরণের চেষ্টা প্রবলভাবে অনুপস্থিত।
আজ সোমবার (১০ জুন) নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত 'অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫' শীর্ষক আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এই অনুষ্ঠান হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, "অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে তিনটি বড় অ্যাক্টরের কথা রেখেছেন। এই তিনটি অ্যাক্টর হচ্ছে – আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(আইএমএফ), অলিগার্ক ও আমলাতন্ত্র।"
তিনি বলেন, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাজেট করা হয়নি। আর অলিগার্ক অর্থাৎ যারা ক্ষমতার প্রশয়ে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ফুলেফেপে উঠেছেন, তাদের কথা চিন্তা করে ব্যাংক, প্রশাসন কোনো খাতেই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কালো টাকার মালিকদের ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে– বিনাপ্রশ্নে তা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর আমলাতন্ত্রের কথা বিবেচনা করা হয়েছে বাজেটে। যারা ব্যয় কমানোর পক্ষপাতি নয়। তাদের সুযোগ-সুবিধা যাতে না কমে, সে ব্যবস্থাও রয়েছে। অন্যদিকে, জনকল্যাণমুলক সাহসী চিন্তা করা হয়নি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, "অর্থমন্ত্রী পরিশ্রমী উদ্যোক্তা ও অর্থনৈতিক কর্মীদের কথা শোনেননি বা বিবেচনা করেননি। কারণ এই বাজেটে কর প্রশাসনের সংস্কারের উদ্যোগ নেই। বিজনেস ক্লাইমেট (ব্যবসার পরিবেশ) উন্নয়নে কিছু নেই। আর অর্থনৈতিক কর্মী অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করা হয়নি। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়ানো হয়েছে। মোটরসাইকেল কেনার খরচ বেড়েছে। কর-মুক্ত আয়সীমা বাড়েনি।"
তিনি বলেন, বাজেট সুসংহত না হওয়ায় পাঁচটি সংকট দেখা দিয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ভঙ্গুরতা আরও বেড়েছে। মূল্যষ্ফীতির কারণে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্ররা আরও সংকটে পড়েছে। বাজেটে বলা হয়েছে আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে। "এটা কাগজে নির্ধারণ করা একটি অংক ছাড়া কিছু না। কারণ মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো কর্মকৌশল উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া, কর্মসংস্থানেও সংকট তৈরি হবে। যুবকরা যাবে কোথায়!"
"বিজনেস ক্লাইমেট নিয়েও সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ শতাংশের বেশি করার কথা বলা হয়েছে। আবার বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনাও বড়। এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতি উদ্যোক্তাদের ভরসা নেই। এই ভরসার সংকট দূর করা গেলে- উদ্যোক্তারা জিডিপির ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগকে নিতে পারতেন।"
"সর্বশেষ সংকট নৈতিকতার। কারণ সৎ করদাতাদের ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে। আর অসৎ ব্যক্তিরা তাদের অবৈধ অর্থ বা সম্পদ মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধতা পাবেন। তাহলে রাষ্ট্রের প্রণোদনা কারা পাচ্ছে– এই প্রশ্ন সবার আগে চলে আসে"- তিনি উল্লেখ করেন।
হোসেন জিল্লুর রহমানের মন্তব্য করেন, বর্তমানে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে ঋণ-নির্ভর অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে দেশ। ব্যয়ও হচ্ছে অদক্ষভাবে। দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রে রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় নৈতিকতার পুনর্জাগরণ দরকার।