সরকার অতিরিক্ত ব্যাংকঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে: ফাহমিদা খাতুন
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকঋণের প্রতি সরকারের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা একপর্যায়ে বেসরকারি খাতের জন্য 'ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট' তৈরি করতে পারে।
রাজধানীতে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত 'অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট' শীর্ষক আলোচনায় তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় ব্যাংকঋণের সুদহার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট হলো একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব। এ তত্ত্বানুসারে, ক্রমবর্ধমান সরকারি খাতের ব্যয় বেসরকারি খাতের ব্যয়কে কমিয়ে বা এমনকি নির্মূলও করে ফেলে।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্যে ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৪.৫ শতাংশ ঘাটতি রাখা হয়েছে। এই ঘাটতির ২.৫ শতাংশ অথবা ১.৩৭ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।
'এছাড়া চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংকঋণের পরিমাণ ১.৫৫ লাখ লাখ কোটি টাকা বৃদ্ধি করেছে। ব্যাংকঋণের প্রতি সরকারের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা একপর্যায়ে বেসরকারি খাতের জন্য ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট তৈরি করতে পারে।'
এই অর্থনীতিবিদের মতে, গত দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ এবং দেশের সম্পদ সীমাবদ্ধতার কারণে বাজেট ঘাটতি আরও কম রাখা উচিত ছিল।
আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'প্রস্তাবিত বাজেটে চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করার জন্য কোনো ভাল পদক্ষেপ নেই।'
সরকার আবারও পরোক্ষ করের প্রতি আস্থা রেখেছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এটা সাধারণ মানুষকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেমন ভ্যাট। একজন নিম্ন-আয়ের মানুষ যে ভ্যাট দিয়ে রুটি কিনেন, ঠিক একই ভ্যাট দিয়ে একজন ধনী মানুষ কিনছেন, যা ঠিক না। এটা বন্ধ করা উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের উন্নয়নের জন্য যে পিলারগুলো রয়েছে, তা খুবই নড়বড়ে। এই পিলারগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, ক্যাপিটাল মার্কেট।'
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে বলে মন্তব্য করেন সাবেক গভর্নর।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সাম্প্রতিক এক ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না।
'সম্প্রতি সরকারি একটি ব্যাংকে ঋণের জন্য গিয়েছিলাম। সেখানকার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার মতো ফান্ড নেই। কারণ সবই এখন বন্ডে চলে যাচ্ছে।'
বিটিএমএ সভাপতি আরও বলেন, 'মধ্যম-আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। এর জন্য সরকার ইকনোমিক জোন করেছে। কিন্তু পানির ব্যবস্থা করেনি। বরং এই বাজেটে সেখানে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে মেশিনারিজ আমদানিতে শুল্ক বসিয়েছে। এদিকে ব্যাংকেও টাকা নেই। তাহলে স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ কীভাবে বৃদ্ধি পাবে?'
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে খোকন বলেন, 'যেসব ঋণ বেনামি, অর্থাৎ যেটা কখনোই ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়, সেটা ডিফল্ট ঋণ। আর যেসব ব্যবসায়ী সবসময় ঋণ পরিশোধ করেছেন, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা করোনার কারণে ব্যবসার অবস্থা খারাপ হওয়ায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি সেটা নন-পারফর্মিং লোন।'
ব্যাংকগুলোকে বেনামি ঋণ প্রদান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নন-পারফর্মিং ঋণ কমিয়ে আনতে সরকারকে ব্যবসায়ীদের নীতি সহায়তা দিতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমালোচনা করে খোকন বলেন, 'কর নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা যে দাবিগুলো দিয়ে আসছি, সেগুলো এনবিআরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়, ওই পাশে আর যায় না। তাই আমাদের দাবি, কোনো পলিসি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যবসায়ীদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। নাহলে কোনো খাতই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। অনেক ভালো ভালো খাত, যেমন চামড়া, পাট এখন ধুঁকছে শুধুমাত্র ভাল পলিসির অভাবে'
দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার জন্য তিনি সরকারের জ্বালানি আমদানিকে দায়ী করে বলেন, সরকার ডলার খরচ করে বিদ্যুৎ কোম্পানির জন্য জ্বালানি আমদানি করেছে। সেই বিদ্যুৎ টাকায় বিক্রি করে কোম্পানিগুলোকে আবার ডলারে কনভার্ট করে ফেরত দিয়েছে। 'তাহলে রিজার্ভ বাড়বে কীভাবে?'
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, 'সরকার বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলছে। কিন্তু বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য মুদ্রার মানের স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারেনি।
'বরং বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ঢুকছে। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা যদি বিদেশে না নিয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা বিনিয়োগ করবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'দেশের শিল্পের দেখাশোনা করার জন্য কোনো মন্ত্রণালয় নেই। একজন শিল্পমন্ত্রী আছেন, তিনি সরকারি শিল্পকারখানা দেখেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে, সেখানকার মন্ত্রী বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেন। দেশের শিল্প দেখবে, এমন মন্ত্রণালয় দেশে নেই।'
পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিকে যথেষ্ট মনে করছেন।
'কিন্তু আমাদের দেখতে হবে, দেশের টাকা সরবরাহের একটি বড় অংশ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে হয়। তাই শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, 'আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সরকার জ্বালানির ওপর ভর্তুকি ধাপে ধাপে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে জ্বালানির দাম বাড়ছে। এই জ্বালানির দাম বৃদ্ধি সরাসরি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তাই সরকারের উচিত জ্বালানির মূল্য না বাড়িয়ে বিকল্প কোনো উপায়ে ভর্তুকি কমিয়ে আনা।'