কর অবকাশের সুবিধার ইতি টানা হচ্ছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা
গত ৬ জুন আসন্ন নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়। বেসরকারিখাতের সম্পৃক্ততায় দেশব্যাপী গড়ে তোলা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে সরকারের অঙ্গীকার বাজেট ঘোষণায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণায়, সরকার বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য আগে দেওয়া ১০ বছর মেয়াদি কর অবকাশ সুবিধা বাতিল করে। বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের জন্য জন্য এটা ছিল অপ্রত্যাশিত। এই ঘোষণা তাদেরকে বিস্মিতও করেছে।
বাজেটে রাজস্ব-সংক্রান্ত এসব পদক্ষেপের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বিনিয়োগ হাব হিসেবে ইজেডগুলোর কার্যকারিতা এবং বার্ষিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন তারা।
কর অবকাশ সুবিধা অবশ্য থাকছে, তবে সেটা কেবল পাবেন সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের নতুন বিনিয়োগকারীরা। গত ২৯ মে পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এছাড়া, আগামী অর্থবছর থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি, উপকরণ, নির্মাণসামগ্রী ও কাঁচামাল শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধাও পাবেন না ইজেডের বিনিয়োগকারীরা।
যার ফলে এসব শিল্প এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোকে এখন ১ শতাংশ আবগারি শুল্ক দিতে হবে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা নির্মাণকারী যদি থার্ড পার্টি কোম্পানি হয়– তাহলে আবগারি শুল্কের হার ১ শতাংশই হবে। তবে হাইটেক পার্কে হলে তা ৫ শতাংশ পর্যন্ত হবে।
রাজস্ব নীতির এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ চাইছেন বিনিয়োগকারীরা, একইসাথে আগে দেওয়া কর-সুবিধাগুলো পুনর্বহালের দাবিও করছেন।
এনিয়ে গত ১২ জুন তাঁরা অর্থমন্ত্রী এবং রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করে জানান, এসব প্রণোদনা ছাড়া এই মুহূর্তে অতি-জরুরি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পাবে না বাংলাদেশ; যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের নির্ধারিত শিল্পায়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে ব্যাহত করবে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) বর্তমানে তিনটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিচালনা করছে, এবং চতুর্থটির জন্য প্রাক-যোগ্যতা সনদ নিয়েছে। দেশের এই বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, "ইকোনমিক জোনের বিষয়ে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো বিনিয়োগকারীদের এই বার্তাই দেবে যে বাংলাদেশে নীতি পূর্বাভাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে।'
টিবিএসকে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের নতুন বিনিয়োগে কর আরোপ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় তেমন একটা হবে না। যেমন বেসরকারি জোনে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ থেকে এনবিআর রাজস্ব আদায় করবে ১২০ কোটি টাকা (১ বিলিয়ন ডলারে ১ শতাংশ কর হিসাব করে, টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটি)।
"কিন্তু ব্যবসা পরিচালনা এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরো সহজ করা হলে সরকার আরো বেশি রাজস্ব আয় করতে পারবে। অর্থমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনবেন"- যোগ করেন মোস্তফা কামাল।
বর্তমানে টিআইসি ম্যানুফ্যাকচারিং বাংলাদেশ, টিআইসি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ, সান ফার্মাসিউটিক্যালস, সিগরেক বাংলাদেশ, জতুন বাংলাদেশ, ইসমারতু টেকনোলজি বাংলাদেশ, সিকা বাংলাদেশ এবং সাকাতা ইনকস-সহ বিদেশী কোম্পানিগুলো মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে কারখানা স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন-ও মনে করেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তটি যথাযথ হয়নি। টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমি এটা প্রত্যাহারের পরামর্শ দেব, আর আশা করছি সরকার সেটি বিবেচনায় নেবে।"
কেন ইজেডগুলোর কর নীতিতে পরিবর্তন আনলো এনবিআর
এনবিআরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, বেজা থেকে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক হিসেবে অনুমোদন নিয়ে বিদ্যমান কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান অন্যায্যভাবে কর সুবিধা নিচ্ছে। এটা অব্যাহত রাখলে, ভবিষ্যতে আরো বিদ্যমান আরো শিল্প প্রতিষ্ঠান ইজেড ও হাইটেক পার্ক হিসেবে স্বীকৃতি চাইবে। কর সুবিধার অপব্যবহার বন্ধ এবং এসব খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যেই এসব পরিবর্তন আনা হয়।
অর্থমন্ত্রণালয় ও এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের কথা রয়েছে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরে আর এত কর সুবিধা দেওয়া যাবে না। তাই এসব উদ্যোগ ধাপে ধাপে কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোরও সহায়ক হবে।
এনবিআরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইজেড ও হাইটেক পার্কগুলো সামষ্টিকভাবে প্রায় ৪ হাজার ২২ কোটি টাকার কর অব্যাহতি পেয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ব্যয় ১৫ হাজার কোটি টাকা কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এনবিআরের সাম্প্রতিক সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) অনুসারে, বিদ্যমান কোম্পানিগুলোকে সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন কোম্পানির সাথে একীভূতকরণ, বিচ্ছিন্নকরণ অথবা পুনর্গঠনের মাধ্যমে কর অবকাশের সুবিধা পেতে দেওয়া হবে না।
সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানাগুলোয় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পুনর্ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হবে না বলে জানায় এনবিআর।
বর্তমানে কার্যক্রম শুরুর প্রথম বছর থেকে শুরু করে এক দশক ধরে কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছেন ইজেডগুলোর বিনিয়োগকারীরা। এরমধ্যে প্রথম তিন বছর তাঁরা সম্পূর্ণ কর মওকুফ পান, এরপর চতুর্থ বছরে ৮০ শতাংশ, পঞ্চম বছরে ৭০ শতাংশ এবং ষষ্ঠ বছরে ৬০ শতাংশ হারে এই সুবিধা পান। কর মওকুফের এই হার প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে কমে দশম বছরে ২০ শতাংশ নেমে আসে।
এছাড়া, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় কারিগরি সহায়তাকারী হিসেবে কর্মরত বিদেশীরা, চাকুরিতে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রথম তিন বছর তাঁদের বেতনের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর ছাড় পান। তবে আগামী অর্থবছর থেকে আর এ সুবিধাটি থাকছে না।
বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন কেন
দেশের বৃহত্তম বেসরকারি অর্থনৈতিক কেন্দ্র– সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনে নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। কারণ আগামী বছরের মধ্যেই এটিকে উৎপাদনে নিতে চান বিনিয়োগকারীরা। যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতেও নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে।
বর্তমানে, সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর কাছে যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ১,০৪১ একর ইজেডের মধ্যে কারখানা স্থাপনের জন্য ১৫টি কোম্পানিকে ১১০ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন লিমিটেডের একজন পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "অর্থনৈতিক অঞ্চলের যে সুবিধাগুলো দেয়া হবে বলা হয়েছিল, সেটা এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে বিশ্বাস ভেঙ্গে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। যে ১৫টি প্রতিষ্ঠান এখানে জমি বরাদ্দ নিয়েছে, এরমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারের পরিকল্পনা করেছিল। তারা এখন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে।"
মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সুমন ভৌমিক বলেন, "বর্তমানে মেঘনা গ্রুপের দুইটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য ৭টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাইপলাইনে আছে। এখন তারা যদি আগের প্রতিশ্রুত সুবিধাগুলো না পায়, তাহলে আর বিনিয়োগ করবে না। আমরাই বা তাদের কী বলব?"
অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের সংগঠন- বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের (বেজিয়া) প্রধান নির্বাহী অপরূপ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, বেজার সাথে একটা সমঝোতার অংশ ছিল এসব সুযোগ-সুবিধা। এগুলো প্রত্যাহারের ঘটনা বেসরকারি ইজেডের উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, সুবিধাগুলো প্রত্যাহার করা হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অন্য দেশে চলে যেতে পারে।