২৮ ঘণ্টায় ১০ বার লোডশেডিং! এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায় টেক্সটাইল শিল্প
লোডশেডিং এখন এতটাই সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে প্রায় সকলেই একে নিয়মিত ঘটনা বলেই ধরে নিয়েছেন। তবুও একদিনে কয়বার হতে পারে লোডশেডিং? একবার, দুইবার বা চারবার? কিন্তু, যদি তা হয় ২৮ ঘন্টার মধ্যেই ১০ বার? তা-ও আবার শিল্প প্রতিষ্ঠানে?
সাম্প্রতিক সময়ে যখন লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বেড়েছে, তখন এই বিদ্যুৎহীনতা কয়বার ঘটছে এবং সেকারণে কয়বার তার কারখানার ইউনিটগুলো পুনরায় চালু করতে হচ্ছে – তার হিসাব রাখতে শুরু করেন নারায়ণগঞ্জের এনজেড অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপক। কারণ লোডশেডিংয়ের পরে কারখানার যন্ত্রপাতি চালু করতেও অনেকটা সময় লাগে। তাতেও নষ্ট হয় উৎপাদন ঘণ্টা।
গত ৬ জুলাই তাদের টেক্সটাইল কারখানাগুলোয় ২৮ ঘণ্টার মধ্যে – প্রতিটি গড়ে এক ঘণ্টা করে স্থায়ী – ১০ বার লোডশেডিং হওয়ার হিসাব রেখেছেন তিনি। যা শুরু হয় সকাল ১১টা থেকে।
এই পর্যবেক্ষণের তথ্য নিজেদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার করেছেন এই কারখানা মালিক। ওই ম্যাসেজের স্ক্রিনশট হাতে এসেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের।
লোডশেডিংয়ে নষ্ট হচ্ছে দামি যন্ত্রপাতি
কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউধ জামান খান টিবিএসকে বলেন, "ঘন ঘন লোডশেডিং আমাদের প্রায় ১৫ ধরনের দামি ও উন্নত যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক কম্পোনেন্ট নষ্ট করছে, এতে প্রতি মাসে প্রায় ৪ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এসব মেশিন বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায় না, আবার আমদানি করতেও অনেক সময় লাগে। এতে উৎপাদন কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি মেটাতেও দেরী হচ্ছে।"
ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে এই ব্যবসায়ী, যিনি বাংলাদেশের বস্ত্রকল মালিকদের সমিতি–বিটিএমএ'র-ও সভাপতি বলেন, "পাওয়ার কাটের কারণে গত মাসে আমার উৎপাদনের ক্ষতি ছয় কোটি টাকার বেশি হয়েছে।" তিনি জানান, উৎপাদন এভাবে ব্যাহত হওয়ায় ক্রেতাদের চালান পাঠাতেও বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছেন, ফলে কীভাবে শ্রমিকদের বেতন ও ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবেন– তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
এই বস্ত্রকল মালিক উল্লেখ করেন, চলমান বিদ্যুৎ সংকট এরমধ্যেই তার কারখানার উৎপাদনকে মোট সক্ষমতার ৪০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। গত দুদিনে যেমন হয়েছে তেমন অবস্থাই যদি চলতে থাকে, তবে উৎপাদনের আরও পতন হবে।
এমন অবস্থা কেবল এনজেড অ্যাপারেলসের-ই নয়। গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও মানিকগঞ্জের শিল্পগুলোও গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকটে জর্জরিত।
টেক্সটাইল উৎপাদন কমেছে ৪০ শতাংশ
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন- বিটিএমএ'র ১,৭০০-র বেশি বস্ত্রকলের প্রতিনিধিত্ব করছে। সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তাদের সদস্য কারখানাগুলোর উৎপাদন গড়ে ৪০ শতাংশ কমে গেছে।
শিল্পখাতের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, টেক্সটাইল শিল্পের মধ্যে স্পিনিং, ডাইং, প্রিন্টিং ইউনিটগুলো গ্যাস সরবরাহের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। একইভাবে সিরামিক, ইস্পাতসহ গ্যাসের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল অন্যান্য শিল্প কারখানাও একইরকম প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে।
এসব সমস্যার মধ্যেও বিদ্যমান বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন উদ্যোক্তারা।
রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিলের কথাই ধরা যাক। রোববার সকাল ৯টা থেকে শুরু করে ছয় ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হয় এ কারখানা, যা পরবর্তীতে ১২ ঘন্টাব্যাপী স্থায়ী হয়। সারাদিনে গ্যাসের চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে (পিএসআই) ছিল মাত্র ১.৫ পাউন্ড, যা স্ট্যান্ডার্ড ১০ পিএসআইয়ের অনেক নিচে।
একইদিন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বস্ত্রকল মালিকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি ম্যাসেজ শেয়ার করেন, সেটিও সংগ্রহ করেছে টিবিএস।
ওই ম্যাসেজে তিনি লিখেছেন, "আমাদের মিলের ৫৪ হাজার স্পিন্ডলের মধ্যে মাত্র ৫ হাজার চালু রয়েছে।"
টিবিএসের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, "স্পিনিং টেক্সটাইল শিল্প পরিচালনায় আমার ৩৭ বছরের অভিজ্ঞতা, এরমধ্যে বর্তমানেই সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্যে আছি, এই পরিস্থিতি দুঃসহ।"
নাম না প্রকাশের শর্তে টেক্সটাইল শিল্পের একজন উদ্যোক্তা টিবিএসকে জানান, গত দুই মাসে তিনি ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার লোকসান গুনেছেন। আরও পাঁচজন বস্ত্রকল মালিকের সাথে কথা বলেছে টিবিএস। তাঁরা সকলেই চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে বিষম সমস্যার মধ্যে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এছাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের স্বল্পতায় কিছু টেক্সটাইল মিলের উৎপাদন লাইন বন্ধ থাকার ছবিও এসেছে টিবিএসের হাতে। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে অনেক টেক্সটাইল মিলই স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
নারায়ণগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক নূর মোহাম্মদ নারায়ণগঞ্জের বেশকিছু এলাকায় লোডশেডিং পরিস্থিতির অবনতির কথা স্বীকার করেন। টিবিএসকে তিনি বলেন, "আগে আমাদের দিনে দুই ঘন্টার মতো লোডশেডিং ছিল। কিন্তু, গত দুই দিনে তা অনেকটা বেড়েছে। রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারের মতো এলাকায় দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। কেবল এ দুটি এলাকাতেই বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ২১০ মেগাওয়াট। "
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, কাঞ্চন বিদ্যুৎকেন্দ্রে (কাঞ্চন পূর্বাচল পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড) উৎপাদন হ্রাস পাওয়া এবং জাতীয় গ্রিডে এর সরবরাহ না থাকায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আগামী সপ্তাহ নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক মো. কামরুজ্জামান খান চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। টিবিএসকে তিনি বলেন, "সাইক্লোন রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) মেরামতের পর সিঙ্গাপুর ত্যাগ করেছে, আগামী ১৩ জুলাই এটি বাংলাদেশে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।"
"তারপর এটা কমিশনে আনতে আরও তিনদিন লাগবে, এই হিসাবে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে চালু করা যাবে। আশা করছি, তখন থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।"
রপ্তানি কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিখাতই স্থানীয় টেক্সটাইল বা বস্ত্রশিল্পের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। নিট পোশাক কারখানার ৮০ শতাংশ এবং উভেন পোশাক কারখানার রপ্তানি পণ্যের ৪০ শতাংশ কাঁচামালই সরবরাহ করে স্থানীয় বস্ত্রকলগুলো।
স্থানীয় এসব বস্ত্রকলে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় পোশাক শিল্পকে এসব কাঁচামালের জন্য আমদানির ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বিটিএমএ'র তথ্য বলছে, গত এক বছরে সুতা আমদানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
এছাড়া, স্থানীয় কারখানা থেকে সুতা বা ফ্যাব্রিক ডাইংয়ের সেবা ব্যাহত হওয়ায় – পোশাক রপ্তানিকারকরাও সময়মতো রপ্তানির কার্যাদেশের চালান পাঠাতে বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছেন।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ফ্যাব্রিকের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায়– সময়মতো বিদেশি ক্রেতাদের কার্যাদেশ পূরণের বিষয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লাহ অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী। এই অবস্থায়, তিনি বায়িং হাউজগুলোর কাছে কার্যাদেশ বাতিল বা মূল্যছাড় দাবি না করারও অনুরোধ করেছেন।
তিনি বলেন, "কিছু পোশাকের চালান হয়তো বিমানে করে পাঠাতে হবে। সুতা ও ফ্যাব্রিকের জন্য আমি পুরোপুরি স্থানীয় উৎসগুলোর ওপর নির্ভর করতাম, কিন্তু এখন আমাকে কাঁচামালের ৭০ শতাংশই হয়তো আমদানি করতে হবে। অন্য কোনো উপায়ও নেই।"