৫৮৮ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি ৪০ প্রতিষ্ঠান
বিতর্কিত ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ এবং বেক্সিমকো গ্রুপ সহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান গত এক দশকে রপ্তানি আয় থেকে উপার্জিত ৫৮৮ মিলিয়ন ডলার দেশে আনেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন অনিয়ম ও প্রতারণার মাধ্যমে এই অর্থ আনতে ব্যর্থ হয়েছে, যা দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকাভিত্তিক শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান ৫৫৯ মিলিয়ন ডলার এবং চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি। সব মিলিয়ে এই ৪০টি প্রতিষ্ঠান এখনো প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেড় বছর আগে আমাদের বকেয়া রপ্তানি আয় ১.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বুধবার পর্যন্ত এটি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।"
তিনি আরও বলেন, "তবে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিসমিল্লাহ ও বেক্সিমকো গ্রুপের আয় কয়েক বছর ধরে আটকে আছে। উপরন্তু ক্রিসেন্ট গ্রুপ রপ্তানি নথি জালিয়াতি করেছে, যার ফলে তাদের অর্থ বহু বছর ধরে দেশে আনা হচ্ছে না। বাকিগুলো প্রতিষ্ঠানগুলোও দীর্ঘ সময়ের জন্য আয় ফেরত দেয়নি।"
তবে একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠানের আয় এক বছরেরও কম সময় ধরে বকেয়া রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
ঢাকাস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৪.৭৬ মিলিয়ন ডলার দেশে আনেনি ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান
রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড। অনিয়ম ও কারসাজি করে জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এম এ কাদের ও তার ভাই জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে।
এছাড়া এই গ্রুপের আরো দুটি প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস এবং রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যার এক্সপোর্ট যথাক্রমে ৫৬.২৫ মিলিয়ন ডলার এবং ৫১.৭১ মিলিয়ন ডলার দেশে আনেনি। মোটের ওপর ক্রিসেন্ট গ্রুপ রপ্তানি করেও দেশে আনেনি ১৭৩ মিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি টাকার বেশি রপ্তানি বিল।
অন্যদিকে ভুয়া রপ্তানি বিল তৈরি করে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকসহ পাঁচটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত বিসমিল্লাহ গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে রপ্তানি আয়ের প্রায় ১২৪ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা দেশে আনেনি।
এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলপ্পা কম্পোজিট টাওয়েল, বিসমিল্লাহ টাওয়েল, হিন্দুলওয়ালী টেক্সটাইল এবং সাহাবিশ কম্পোজিট টাওয়েল যথাক্রমে ৫৮.১ মিলিয়ন ডলার, ৪১.৪৫ মিলিয়ন ডলার, ১৪.৫৪ মিলিয়ন ডলার এবং ৯.৬৯ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি।
এদিকে দেশের আর্থিক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেওয়া বেক্সিমকো গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি আয় ফিরিয়ে না আনা ঢাকাভিত্তিক শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপ প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে বেক্সটেক্স গার্মেন্টস ২৪ মিলিয়ন ডলার, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার এন্ড এ্যাপারেলস ২৫.১৮ মিলিয়ন ডলার, অ্যাসেস ফ্যাশন ২৪.৪৫ ডলার এবং অ্যাপোলো এ্যাপারেলস ২৩ মিলিয়ন রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আনেনি।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সালমানের বড় ভাই আহমেদ সোহেল ফসিহুর রহমান এই গ্রুপের চেয়ারম্যান।
যোগাযোগ করা হলে বেক্সিমকো গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক আবু শফিউল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের গ্রুপ অনেক বড়। আমি এই বিষয়ে সঠিক জানি না।" তিনি গ্রুপের অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অন্য কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, "সাধারণত কোনো রপ্তানিকারক তাদের অর্থপ্রদান দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারে না। যদি রপ্তানি আয় দীর্ঘ সময়ের জন্য বিলম্বিত হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, অর্থ পাচার করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকলে সেটিকে ব্যাংক ঋণসহ অনেক সুবিধা দেওয়া উচিত নয়।
আকিজ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আকিজ জুট মিলস রপ্তানি আয়ের ২০.৮৩ মিলিয়ন ডলার দেশে আনেনি।
এছাড়া লেনি ফ্যাশন ৩২.৫৮ মিলিয়ন ডলার, এসবি এক্সিম ৩১.৬৫ মিলিয়ন ডলার, এসকিউ সেলসিয়াস ২৭.২৮ মিলিয়ন ডলার, অ্যাপোলো এ্যাপারেলস ২৩ মিলিয়ন ডলার, কুন টং এ্যাপারেলস ১৫.১ মিলিয়ন ডলার, কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার ১০ মিলিয়ন ডলার, রেডপয়েন্ট জ্যাকেটস ৯.৯৮ মিলিয়ন ডলার, জেপডক'স ৯.৪ মিলিয়ন ডলার এবং জেন'স ৪ মিলিয়ন ডলার এবং এসকিউ বিরিছিনা ৮.৮৩ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি।
চট্টগ্রামের শীর্ষ ২০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নর্থপোল বিডি ১০.৮৩ মিলিয়ন ডলার, নর্ম আউটফিট অ্যান্ড অ্যাকসেসরিজ ৩.৩৪ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার, ভেলটেক্স ইন্টারন্যাশনাল ২.৮৩ মিলিয়ন ডলার, মোডিস্টে (চট্টগ্রাম ইপিজেড) ২.৬২ মিলিয়ন ডলার এবং এসএন ফ্যাশন ১.৬২ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি।