শেখ হাসিনার পতনের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ
কয়েক বছরের ধারাবাহিক মন্দার পর শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির মাধ্যমে ১৫ বছরের শাসনের অবসান শেষে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার লেনদেন ৫০১ শতাংশ বেড়ে ৪০৪ কোটি ৮২ লাখ টাকায় পৌঁছেছে।
এক বছর আগে ১ থেকে ১৫ আগস্ট দেশের প্রধান শেয়ারবাজারে বৈদেশিক লেনদেন ছিল মাত্র ৬৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ডিএসইতে টার্নওভার এবং সূচক উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ১১ আগস্ট পর্যন্ত ৪টি ব্যবসায়িক সেশনে বেঞ্চমার্ক সূচক ৭৮৬ পয়েন্টে উঠেছিল।
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে বাজারে আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া আগস্টের প্রথমার্ধে বৈদেশিক শেয়ার লেনদেন পুরো অর্থবছরের ২৬২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা আগের পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টার্নওভার ছিল আট হাজার ৯১ কোটি টাকা। পরবর্তী অর্থবছরে এ অঙ্ক বেড়ে নয় হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা হয়।
এরপরের অর্থবছরগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টার্নওভার নিম্নমুখী ছিল। ২০২২–২৩ অর্থবছরে তা দুই হাজার ৯৫৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছিল।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের অস্থিরতা, কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ফ্লোর প্রাইস আরোপ, কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে 'নিষ্ক্রিয়' ছিল।
ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে বিভিন্ন কোম্পানিতে পূর্বের বিনিয়োগ আটকে যাওয়ায় নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগতো করেইনি, বরং কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে মূলধন তুলে নেওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি।
কিন্তু এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তারা শেয়ার বিক্রির চেয়ে মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে
বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এ নতুন বিনিয়োগের কারণে আগস্টের প্রথম ১৫ দিনে লেনদেনের পরিমাণক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শীর্ষস্থানীয় ট্রেডিং ফার্ম ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।'
'আগস্ট মাসে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট শেয়ার কেনার পরিমাণ অনেক বেশি। যদিও আগের মাসগুলোতে তাদের শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি,' বলেন তিনি।
আহসানুর রহমান বিদেশি বিনিয়োগের আকস্মিক বৃদ্ধির ৪টি মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন: নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় পুঁজিবাজার নিয়ে বিদেশিদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাওয়া; ব্যাংক খাতের সংস্কার; বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা; এবং মানসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যাওয়া।
তিনি বলেন, 'ব্যাংক খাতের সংস্কারে নতুন সরকার ভালো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়েছে। এসব কারণে পুঁজিবাজারে শেয়ার কিনতে বিদেশিদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।'
আগস্টের প্রথমার্ধে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের বিষয়টিকে খুবই আশাব্যঞ্জক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, পুরো মাসের হিসেবে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেন যেকোনো সময়ের একক কোনো মাসকে ছাড়িয়ে যাবে।
বড় বাধা ছিল ফ্লোর প্রাইস
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশেকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে পুঁজিবাজারের নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট ও বিদেশিদের শেয়ার লেনদেন না করার বড় বাধা ছিল ফ্লোর প্রাইস।'
তিনি বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একটি টার্গেট বা টাইমফ্রেম ধরে বিনিয়োগ করে। কিন্তু ফ্লোরের কারণে যখন তারা আটকে যায়, তারা শেয়ার কেনাবেচা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নিজেদেরকে বাজার থেকে সরিয়ে সাইডলাইনে চলে যায়।'
রহমান আরও উল্লেখ করেন, ডলারের দামের বড় ধরনের ওঠানামার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে দূরে সরে গেছে। যার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেনার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
'এখন নতুন সরকার আসায় সুযোগ মনে করে আবার বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা,' বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, কৃত্রিমভাবে শেয়ার দাম ধরে রাখতে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
দেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্তের পর যখন পুঁজিবাজার অনেক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়, তখন বিএসইসি ২০২০ সালের মার্চে পৃথক স্টকের ওপর ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। যার ফলে এসব স্টকের দাম একটি নির্দিষ্ট স্তরের নিচে নামতে পারেনি।
এরপর বাজার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বাজারে আবার ধাক্কা লাগে। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই বিএসইসি আবারও ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে।
প্রায় দেড় বছর ফ্লোর প্রাইস চলমান থাকার পর চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি ৩৫ কোম্পানির শেয়ার ছাড়া বাকি সব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়। ধাপে ধাপে আরও কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর এখন ইসলামী ব্যাংক ও বেক্সিমকোর শেয়ারের ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রয়েছে।
আশেকুর বলেন, 'বিদেশিরা বিগত বছরগুলোতে শেয়ার বিক্রি করে তহবিল নিয়ে সাইডলাইনে ছিল। তারা পরিস্থিতি বুঝে এখন বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। কারণ তারা মনে করছে, ব্লু-চিপ কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করলে ভালো রিটার্ন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।'
পুঁজিবাজারে সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'ডলার সংকটের কারণে অনেকে বিদেশে টাকা পাঠাতে পারছে না। এখন যেহেতু নতুন সরকার এসেছে, আস্থা ফিরে পেয়ে নতুন করে বিনিয়োগ করছে।'
আগামীতে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি ভালো এবং ডলার মার্কেট স্থিতিশীল থাকলে বিদেশিরা দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আরও বাড়াবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।