শেয়ার কারসাজি করে কোটি কোটি টাকা: জরিমানা অনাদায়ী, সরকারি কর্মকর্তা হিরুর বিরুদ্ধে মামলা
সরকারি কর্মকর্তা আবুল খায়ের ওরফে হিরু। পুঁজিবাজারের বড় বিনিয়োগকারী। সমবায় ক্যাডারের এই কর্মকর্তার আছে বাজারকে ইচ্ছামতো প্রভাবিত করার ক্ষমতা। তিনি যখন কোনো শেয়ার কেনেন, অন্য বিনিয়োগকারীরাও তার পথ অনুসরণ করেন, কারণ তারা জানেন এ শেয়ারে বিনিয়োগ নিশ্চিত লাভজনক। এই বিপুল প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বহু শেয়ারের মূল্য নিয়ে কারসাজি করেছেন হিরু, দ্রুত মুনাফা অর্জন করেছেন।
প্রায় এক ডজন কোম্পানির শেয়ারদর নিয়ে এমন কারসাজির দায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০২২ সালে বিভিন্ন সময়ে হিরু ও তার সহযোগীদের জরিমানা করে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা জরিমানার টাকা পরিশোধ না করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এখন তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করেছে।
কমিশনের একটি এনফোর্সমেন্ট রিপোর্ট তথ্য অনুযায়ী, ১১টি কোম্পানির শেয়ারমূল্যে প্রভাব খাটিয়ে সিকিউরিটিজ আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য আসামিদের ১৪ কোটি টাকারও বেশি জরিমানা করা হয়। কিন্তু এরপর প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও গত ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত হিরু ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বকেয়া জরিমানা আদায়ের জন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট বিভাগ চারটি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করেছে।
নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ না করায় শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আগের কমিশন জরিমানা পরিশোধের সময় এক বছর বাড়িয়েছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের কয়েকদিন পরেই পদত্যাগ করেন শিবলী রুবাইয়াত।
১২ কিস্তিতে প্রায় ১০ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য আরও এক বছর সময় চেয়ে কমিশনে আবেদন করেছিলেন হিরু। তবে ১৮ সেপ্টেম্বর কমিশন তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেয়।
জানতে চাইলে হিরু টিবিএসকে বলেন, 'কমিশন জরিমানা করার পর ৫-৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'পরবর্তীতে অবশিষ্ট টাকা পরিশোধে কমিশন একবার সময় বাড়িয়েছিল। তবে বাজার ভালো না থাকা ও শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় জরিমানার টাকা দিতে পারিনি।'
একটি এনফোর্সমেন্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিরু ও তার সহযোগীরা গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, ফরচুন শুজ, ওয়ান ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, বিডি কম অনলাইন, আইপিডিসি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, জেনেক্স ইনফোসিস ও প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারমূল্য কারসাজিতে জড়িত ছিলেন।
পরিবারের সদস্যদেরও জরিমানা
খায়ের, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, তার বাবা আবুল কালাম মাতবর ও তাদের কোম্পানি ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও দেশ আইডিয়াল কো-অপারেটিভকে ২০২২ সালে প্রায় ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করে কমিশন। ১১টি কোম্পানির শেয়ারদরের কারসাজিতে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় তাদেরকে এই জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে অনেকগুলোই বিমা খাতের কোম্পানি।
বিএসইসি এনফোর্সমেন্ট বিভাগের প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, তাদের রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন প্রায় ৫০ কোটি টাকা এবং আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন প্রায় ১০০ কোটি টাকা ছিল।
শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে যে মুনাফা হয়, তা-ই রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন। শেয়ার কেনা হলেও বিক্রি করা হয়নি, কিন্তু বিক্রির জন্য প্রস্তুত থাকলে তাকে বলা হয় আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন।
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদরের কারসাজিতে জড়িত থাকার কারণে হিরু ও তার সহযোগীদের নতুন করে জরিমানা করা হয়।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, হিরু এবং তাদের কোম্পানি—এশাল কমিউনিকেশন, মনার্ক মার্ট, লাভা ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ—ও আবুল কালাম মাতবরকে মোট ১.৬৩ কোটি টাকা জরিমানা করে রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন। এশাল কমিউনিকেশনকে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা, সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা, হিরুকে ২৫ লাখ টাকা এবং মনার্ক মার্ট, লাভা ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও মাতবরকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
৭ অক্টোবর এক চিঠির মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়কে খায়ের ও তার সহযোগীদের করা জরিমানা সম্পর্কে অবহিত করে কমিশন। ওই চিঠিতের একটি কপি এসেছে টিবিএসের হাতে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা খায়ের ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজারে শেয়ার লেনদেনে কারসাজি করেছেন, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য উল্লেখযোগ্য ক্ষতির কারণ হয়েছে এবং বাজারের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করেছে।
কে এই হিরু?
আবুল খায়ের, ওরফে হিরু বর্তমানে সমবায় অধিদপ্তরে উপ-রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। হিরু তার নিজ নামে খোলা একটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেনের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নামে একাধিক বিও অ্যাকাউন্ট খোলেন এবং সেগুলো পরিচালনা করেন।
কমিশনের এক এনফোর্সমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, শেয়ারদরে কারসাজি-সংক্রান্ত প্রতিটি অভিযোগের শুনানিতে হিরু তার ও তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি জমা দিতেন।
শেয়ার লেনদেন ও জরিমানা আইন লঙ্ঘন
কমিশনের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, হিরু ও তার সহযোগীরা সিকিউরিটিজ আইনের ১৭(ঙ)(৫), (১), ও (২) ধারা লঙ্ঘন করেছেন। এর ফলে তারা ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা জরিমানাযোগ্য অপরাধ করেছেন। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সম্ভাবনাও রয়েছে।
পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কেনার মাধ্যমে তারা শেয়ার অর্জন, অধিগ্রহণ ও কর্তৃত্বগ্রহণ বিধিমালা ভঙ্গ করেছেন।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্সের ১৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো শেয়ার কেনাবেচায় কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার, প্রতারণামূলক লেনদেন, কিংবা বিক্রয়-ক্রয় ঠেকানোর উদ্দেশ্যে কিছু করতে পারবেন না।
এছাড়াও এ আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সিকিউরিটিতে ধারাবাহিক লেনদেন করে ওই সিকিউরিটিতে সক্রিয় লেনদেনের মিথ্যা চিত্র সৃষ্টি করতে পারবেন না, শেয়ারের মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়াতে বা কমাতে পারবেন না।
ধারা ১৭-র একটি উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধারাবাহিকভাবে এমন কোনো লেনদেন করতে পারবেন না যার ফলে ওই সিকিউরিটিতে সক্রিয় লেনদেনের আর্বিভাব ঘটে, অথবা অন্যদেরকে ক্রয়ে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে সেটির মূল্যবৃদ্ধি হয় অথবা অন্যদেরকে বিক্রয়ে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ওই সিকিউরিটির মূল্যহ্রাস হয়।
শাস্তির বিষয়ে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, যারা ১৭ ধারা লঙ্ঘন করবেন, তাদের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
কমিশনের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের প্রতিবেদন অনুসারে, আইপিডিসির শেয়ারে কারসাজির করে হিরু ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন হয়েছে ৬.৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে হিরুর ব্যক্তিগত গেইন ছিল ২.২৪ কোটি টাকা ও তার পিতার গেইন ছিল ৪.১১ কোটি টাকা।
অন্যদিকে হিরু ও তার সহযোগী, হিরু, তার স্ত্রী, তার বাবা ও ডিআইটি কো-অপারেটিভের আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন যথাক্রমে ১২.৯৫ কোটি, ২.০৩ কোটি, ৩.২৮ কোটি, ১.৯৭ কোটি ও ১.৩৫ কোটি টাকা।
কারসাজি থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা করলেও হিরুকে মাত্র ১.৫ কোটি টাকা জরিমানা করে কমিশন।
এছাড়া এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ারের কারসাজি থেকে হিরু ও তার সহযোগীদের আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ২৩.৩৩ কোটি টাকা। এ ঘটনায় হিরুর আত্মীয় কনিকা আফরোজ ও তার সহযোগীদের ৩.৭৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজি করে আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ১৪.৩৫ কোটি টাকা। আর তাদের আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ১৪.৩৫ কোটি টাকা। এ ঘটনায় মাতবর ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি টাকা জরিমানা করেছে কমিশন।
গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি থেকে হিরুর স্ত্রী সাদিয়া হাসান ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ১.৮৮ কোটি টাকা। এ ঘটনায় তাদের রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ৫৭ লাখ টাকা। শেয়ার লেনদেন আইন লঙ্ঘনের কারণে সাদিয়া হাসান ও তার সহযোগীদের ৪২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজিতেও ছিল হিরুর নাম। তার নিজ বিও ও স্ত্রীর বিও অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার কেনাবেচা করে হিরুর রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ৪.৩৬ কোটি টাকা। আর আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ৯৫ লাখ টাকা। শেয়ার লেনদেন আইন লঙ্ঘনের দায়ে সাদিয়া হাসান ও তার সহযোগীদের ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির জন্যও হিরুকে জরিমানা করা হয়েছে। দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ-এর শেয়ার কারসাজি করে বিমা খাত থেকে হিরুর রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ৩.২৪ কোটি টাকা। আর আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ৫.২৪ কোটি টাকা। হিরু দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শেয়ার কারসাজির কারণে দেশ আইডিয়ালকে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।
ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজি থেকে মাতবর ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ৬.১৩ কোটি টাকা, আর আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ২৩.৮৯ কোটি টাকা। কমিশন তাদের ১.৫০ কোটি টাকা জরিমানা করে।
বিডিকম অনলাইনের শেয়ার কারসাজির জন্য ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেড ও এর সহযোগীদের ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন। এ শেয়ার কারসাজি থেকে রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ১.৭০ কোটি টাকা ও আনরিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইন ২.৭১ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও সাদিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় ডিআইটি কো-অপারেটিভকে ৩৫ লাখ এবং সাদিয়া ও তার সহযোগীদের ১.৪০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে কমিশন।