সি পার্লের কয়েকশ কোটি টাকার শেয়ার কারসাজি: ভর্ৎসনাতেই ক্ষান্ত ছিল বিএসইসি!
২০২২ সালে মাত্র দুই মাসের মধ্যে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা-এর শেয়ারের দাম তিনগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্ত অনুসারে, এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ছিল পাঁচ তারকা রিসোর্টটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠী, যেটি সমন্বিত শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা অর্জন করে।
তদন্তে দেখা গেছে, শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা রিভিউ পিরিয়ডের সময় শেয়ার বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ২৪.৪৪ কোটি টাকা মুনাফা রিয়ালাইজড করা হলেও লাভের সিংহভাগ — ২৮২ কোটি টাকারও বেশি — কাগজে-কলমে থেকে গেছে।
আনরিয়ালাইজড গেইন এক ধরনের তাত্ত্বিক মুনাফা, যা কেবল কাগজে-কলমেই থাকে। বিনিয়োগ নগদে পরিণত করতে তা বিক্রি না করলে এ ধরনের আনরিয়ালাইজড গেইন তৈরি হয়।
ডিএসই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, রিসোর্টের ১৩ জন প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার নিজেদের মধ্যে বারবার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন করেছিলেন। এর ফলে ২০২২ সালের ৩১ জুলাই থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ারের দাম ৯৩ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
এ কাজে মূল নাটের গুরুদের মধ্যে ছিলেন সি পার্লের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল হক। তিনি এই শেয়ার কারসাজি স্কিমের প্রধান সুবিধাভোগী হয়েছিলেন। ডিএসই সিকিউরিটিজ প্রবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনে তাকে 'একজন শক্তিশালী অংশীদার বা সম্ভাব্য অংশীদার' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ডিএসই ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে এর তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলামের দায়িত্বে থাকা বিএসইসি এ বিষয়ে শেয়ার কারসাজিকারীদের স্রেফ সতর্কীকরণ নোটিশ জারি করেই ক্ষান্ত হয়েছিল বলে জানান বিএসইসির মুখপাত্র ফারহানা ফারুকি।
বিএসইসির নথি অনুযায়ী, অন্যদিকে শেয়ার কারসাজি এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ধারা ১৭ লঙ্ঘনের অনুরূপ আরেকটি ঘটনায় বিএসইসি আবুল খায়ের এবং তার সহযোগীদের কোটি কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করেছিল।
সি পার্লের শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে 'সক্রিয় শেয়ার লেনদেনের একটি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর চিত্র' তৈরি করা হয়েছিল, যা সিকিউরিটিজ আইনের ১৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
তবে কমিশনের নম্র মনোভাবের কারণে সি পার্ল শেয়ারের কারসাজিকারীরা শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। যার সুবাদে ২০২৩ সালের ৯ মার্চ রিসোর্টের শেয়ারের দাম ৩২০ টাকায় পৌঁছে।
এই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ারটির দাম কমে ৪৬.৫ টাকায় নেমে এসেছে। ফলে যারা ২০০ বা ৩০০ টাকার ভিত্তিতে শেয়ার কিনেছিলেন, তারা এখন উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
সি পার্লের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সি পার্লের কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আজহারুল মামুন টিবিএসকে বলেন, 'শেয়ার কারচুপির অভিযোগে অভিযুক্ত সবাই কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার। ডিএসইর তদন্তের ফলাফল যাচাই-বাছাই করে বিএসইসি শুধু সতর্কতা জারি করেছিল।'
ডিএসইর রিপোর্টে উল্লেখ করা কারসাজির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য লাভের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ডিএসই ভুল করেছে।'
শুধু সতর্কতা, নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা—কেন?
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, ডিএসইর প্রতিবেদনে আইন লঙ্ঘন ও শেয়ার লেনদেনে কারসাজির জন্য ১৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে (সি পার্লের প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার) চিহ্নিত করা হয়েছে। জবাবে বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ তাদের সবাইকে শুনানির জন্য তলব করে।
শুনানির সময় চারজনকে সতর্কতা জারি করা হয়। অন্য দুজনকে কোনো সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়নি।
এরপর, এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ শেয়ার কারসাজি ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত সাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিষয়টি কমিশন সভায় উপস্থাপন করে।
তবে ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট কমিশন সভায় সেই সাতজনকে শুধু সতর্কীকরণ চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে ফারহানা ফারুকি টিবিএসকে জানান।
নিছক সতর্কবার্তা দেওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'পূর্ববর্তী কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং কেবল সেই কমিশনের সদস্যরাই এমন সিদ্ধান্তের পেছনের মানদণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।'
টিবিএস তৎকালীন চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়াতের নেতৃত্বাধীন সাবেক কমিশনটির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। চার সাবেক কমিশনারের মধ্যে তিনজন মিজানুর রহমান, শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও রুমানা ইসলাম সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তারা অতীতের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আরেক সাবেক কমিশনার আব্দুল হালিম বলেন, তিনি গত বছরের আগস্টে নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা মনে করতে পারছেন না।
এছাড়া সাবেক বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলামকে টিবিএস-এর পক্ষ থেকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি জবাব দেননি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আইন লঙ্ঘনের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও শুধু একটি সতর্কতা জারি করা উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া নয়।
একটি ব্রোকারেজ ফার্মের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'বাজারে ফাউল প্লে হতে পারে, এবং ভবিষ্যতে অসদাচরণ রোধ করতে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া কমিশনের দায়িত্ব।'
তিনি আরও বলেন, 'আগের কমিশন শেয়ার কারসাজির ক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়ে এবং অন্যদের ক্ষমা করে পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করেছিল। এতে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে যা ফাউল প্লে এবং বাজারের কারসাজিকে উৎসাহিত করে।'
ডিএসইর তদন্তে যা জানা গেছে
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩১ জুলাই থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২-এর মধ্যে সি পার্লের শেয়ারের দাম ২১২.৭৩% বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ টাকা থেকে ১৩৭.৬০ টাকায় ওঠে।
এই মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল শেয়ারপ্রতি ৯৩.৬০ টাকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্ভাব্য এ মহলটি [মো. আমিনুল হকসহ অন্যদের ইঙ্গিত করে] ৭৯.৪৩ লাখ শেয়ার কিনে এবং ১৯টি বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৭৫.০৫ লাখ শেয়ার বিক্রি করে, যার মধ্যে পাঁচটি অ্যাকাউন্টে কোনো লেনদেন পাওয়া যায়নি।
এই ১৯টি অ্যাকাউন্ট সমষ্টিগতভাবে মোট বাণিজ্যের ২০.৪৯%-এর জন্য দায়ী ছিল এবং তদন্তের সময়কালে ২৪.৪৪ কোটি টাকা মূলধন লাভ করেছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ গোষ্ঠীর ক্লায়েন্টরা ২৮২.০৯ কোটি টাকার উল্লেখযোগ্য আনরিয়ালাইটজড গেইন করেছে।
ডিএসই আরও জানিয়েছে, মো. আমিনুল হক ও তার সহযোগীরা তদন্তের সময় একাধিকবার নিজেদের মধ্যে সি পার্লের শেয়ার লেনদেন করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন তারিখে পাবলিক ও ব্লক উভয় মার্কেটে মোট ১৭.৭৫ লাখ শেয়ার লেনদেন করা হয়, যেখানে ক্লায়েন্টরা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের ভূমিকা পালন করেছেন।
যেমন, ২০২২ সালের ১ আগস্ট হেদায়েতুল ইসলাম বিক্রেতা মো. কালাম হোসেনের কাছ থেকে ৮২ হাজার ৮১৫টি শেয়ার ক্রয় করেন এবং মো. আবুল হাসেম রায়হান বিক্রেতা মাহমুদুল আহসানের কাছ থেকে ৯১ হাজার ৩৪০টি শেয়ার কেনেন।
যেভাবে ঘটেছিল কারসাজি
ডিএসই'র তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, তদন্ত দল ক্লায়েন্টদের একটি গ্রুপের মধ্যে একই করা ঠিকানা ও একই ইমেল আইডির মতো কিছু মিল দেখতে পেয়েছে।
যদিও সি পার্লের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল হক সরাসরি তার নিজের বিও [বেনিফিশিয়ারি ওনার] অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন করেননি, তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা আইন লঙ্ঘন করে বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন করেছিলেন।
প্রতিবেদনে এ ব্যক্তিদের মধ্যে পারিবারিক সংযোগও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার মো. আবুল হাসেম রায়হানের বিও অ্যাকাউন্টের মনোনীত প্রার্থী হলেন মো. আমিনুল হক।
একইভাবে, হেদায়েতুল হকের নামে ৩টি বিও অ্যাকাউন্টের একজন মনোনীত প্রার্থী হলেন মো. আমিনুল হকের ছেলে সামিউল হক শাফা। অন্য একজন মনোনীত প্রার্থী কাওসার আহমেদ রনি, যিনি শামীম এন্টারপ্রাইজের পক্ষে সি পার্লের বোর্ডে মনোনীত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
আরেক প্লেসমেন্ট হোল্ডার মাহমুদুল আহসান ভূঁইয়া চারটি বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার কারসাজিতে যুক্ত ছিলেন। সি পার্ল বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক ও তার স্ত্রী লুসি আক্তারী মহলের জামাতা এই মাহমুদুল।
মাহমুদুল আহসানের দুটি বিও অ্যাকাউন্টের জন্য মনোনীত প্রার্থী হলেন আমিনুল-লুসির মেয়ে মাহজাবিন হক মাশা। এছাড়া, আমিনুল হক অন্য একটি বিও অ্যাকাউন্টের জন্য মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। আর মাহমুদুল আহসানের চাচাতো ভাই মো. রোহুল আমিন আরেকটি ভিন্ন অ্যাকাউন্টের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন।
সি পার্লের আরেক প্লেসমেন্ট হোল্ডার মুহাম্মদ আহাসুন উদ্দিন দুটি বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেন করেছেন, যার একটিতে মনোনীত প্রার্থী মাহজাবিন হক মাশা এবং অন্যটিতে মো. আমিনুল হক।
আরেক প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার কাওসার আহমেদ রনির বিও অ্যাকাউন্টেও মো. আমিনুল হককে নমিনি মনোনীত করা হয়েছে। একইভাবে মো. কালাম হোসেন তার বিও অ্যাকাউন্টের জন্য মাহজাবিন হক মাশাকে মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন।
কালাম ভেনাস বিল্ডার্স লিমিটেড এবং ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের বিও অ্যাকাউন্টের কন্টাক্ট পার্সন। উভয় কোম্পানিই সি পার্লের প্লেসমেন্ট হোল্ডার।
বেঙ্গল ভ্যাকেশন ক্লাব লিমিটেডও সি পার্লের প্লেসমেন্ট হোল্ডার। মো. আমিনুল হক, তার স্ত্রী লুসি আক্তারী মহল ও ভাই একরামুল হক সি পার্লের স্পন্সর পরিচালক এবং তারা সবাই বেঙ্গল ভ্যাকেশনের পরিচালক।
এছাড়া মো. আমিনুল হক আরও তিনজন প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার মো. আশরাফ হোসেন, তফিকুল হাসান ও ইমতিয়াজ আহমেদের বিও অ্যাকাউন্টের জন্যও মনোনীত প্রার্থী ছিলেন।