চাহিদা বাড়ায় দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম বেড়েছে ২ টাকা
ডলারের প্রকৃত বাজারদরের অন্যতম প্রধান সূচক রেমিট্যান্স ডলারের দর গত দুই সপ্তাহে প্রায় ২ টাকা বেড়েছে। ঋণপত্রের (এলসি) ওভারডিউ পেমেন্ট নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংক, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর পেমেন্টের চাপ বাড়ায় তাদেরকে বেশি পরিমাণে ডলার কিনতে হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, ওভারডিউ পেমেন্টের পরিমাণ গত দুই মাসে আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। তবে আরও কিছু পেমেন্ট বাকি রয়ে গেছে। আবার প্রতিনিয়ত পেমেন্টের চাপ তৈরি হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানির পেমেন্ট যেমন বাকি রয়েছে, তেমনি আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ওভারডিউ পেমেন্টগুলোও পরিশোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এসব ডলার সংগ্রহের জন্য রেমিট্যান্স ও আন্তঃব্যাংক মার্কেটের ওপর নির্ভর করছে।
অন্তত ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক জানিয়েছে, রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে গত মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সর্বোচ্চ ১২৪.৪০ টাকা রেট দিতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেও রেমিট্যান্সের ডলার ১২২.২০ থেকে ১২২.৫০ টাকা দরে কেনা যেত। নভেম্বরের শুরুতে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ছিল ১২১.৫০ থেকে ১২১.৮০ টাকা।
ডলারের দর কেন বাড়ছে, জানতে চাইলে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেন, আগে জ্বালানি তেলের আমদানি এলসি খুলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো, বেসরকারি ব্যাংকের ওপর তেমন চাপ ছিল না। তবে এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। বর্তমানে ৭-৮টি বেসরকারি ব্যাংক এসব এলসি খুলছে।
একইসঙ্গে এসব আমদানির পেমেন্ট করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করত। নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না বললেই চলে। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ পুনর্গঠনের জন্য বাজার থেকে ডলার কেনা শুরু করেছে। এসব কারণে এলসি পেমেন্টের ডলার জোগাড় করার জন্য ব্যাংকগুলোকে বাজারের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে, যা আদতে ডলারের রেট বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানান তারা।
একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ওভারডিউ পেমেন্ট পরিশোধ করতে রেমিট্যান্স মার্কেট থেকে ডলার কেনা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেওয়ায় সেটি ডলারের রেটকে উসকে দিচ্ছে।'
নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি টিবিএসকে বলেন, 'রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেশি রেট অফার করে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে। ফলে আমাদেরও বাধ্য হয়ে বেশি রেট অফার করতে হচ্ছে। তা না হলে রেমিট্যান্সের ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে ডলারের বাজারে একটা চাপ তৈরি হয়েছে।'
ব্যাংকাররা জানান, আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের রেট বাড়লেও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের সঙ্গে ডলারের রেটের পার্থক্য বাড়েনি। ২.৫ শতাংশ সরকারি প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্সের ডলারের বিপরীতে প্রেরকরা এখন রেট পাচ্ছে সর্বোচ্চ ১২৭.৩০ টাকা। অন্যদিকে অবৈধ হুন্ডি চ্যানেলে ডলার পাঠালে ১২৮-১২৯ টাকা পর্যন্ত মিলছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে এই পার্থক্য বেড়ে ৭-৮ টাকা পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'রেমিট্যান্সের বাজার সবসময়ই রেট-সেন্সিটিভ। যে ব্যাংক বেশি রেট দেবে, তারাই রেমিট্যান্সের ডলার বেশি পাবে। ফলে এখন যেসব ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি বেশি হচ্ছে, তারা বেশি রেট দিয়েই এসব ডলার সংগ্রহ করছে—এটাই সত্য।'
ব্যাংকগুলো এখন রপ্তানির ডলার সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা রেট দিচ্ছে। এছাড়া এলসি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে গ্রাহকভেদে ১২২-১২৪ টাকা দাম রাখা হচ্ছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন সার ও জ্বালানি তেলের আমদানি এলসি খোলার চাহিদা বেশি। একইসঙ্গে আগামী রমজান উপলক্ষে খাদ্যপণ্য আমদানির এলসি খোলার চাহিদাও আছে। ডলারের চাহিদা ও দাম বাড়ার পেছনে এগুলো উল্লেখযোগ্য কারণ। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওভারডিউ পেমেন্টের চাপ কমে এলেও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। ফলে এই ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহে জোর দিচ্ছে।
ডলারের চাহিদা বাড়লেও ক্যাপিটাল মেশিনারিজের মতো ক্যাপিটাল গুডস আমদানি এলসি খোলার চাহিদায় তেমন লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন এই সিজনড ব্যাংকার।
রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আধিপত্য
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২৬.৪৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮.৮১ বিলিয়ন ডলার, চলতি অর্থবছরে সেটি বেড়ে হয়েছে ১১.১৪ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাড়তি রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় পুরোটাই নিয়ে নিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে টেক্কা দিচ্ছে।
অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৫ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—অগ্রণী, জনতা, রূপালী, সোনালী ও কৃষি—রেমিট্যান্স পেয়েছে ৩.৪২ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স পেয়েছিল ১.০৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চলতে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এই ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স প্রাপ্তি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১৭ শতাংশ বেড়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে রূপালী ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ডলার কমেছে ১.৪৬ বিলিয়ন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের বাইরেও দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ফরেন অ্যাকাউন্টে ডলার জমা থাকে। গত আগস্ট মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এসব অ্যাকাউন্টে ডলারের পরিমাণ ১.৪৬ বিলিয়ন কমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, আগস্টের শুরুর দিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ৬.০৯ বিলিয়ন ডলার জমা ছিল। অক্টোবর শেষে সেটি ২৪ শতাংশ কমে ৪.৬২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ডলারের পরিমাণ কেন কমছে। জানতে চাইলে প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে যেসব অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই জমা থাকা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ওঠানামা করে। তবে গত কয়েক মাস ধরে এসব অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা কমেছে। এর একটি কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট (নীতি সুদহার) বাড়িয়ে দেওয়ায় টাকার সুদের হার অনেক বেড়ে গেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ তাদের পলিসি রেট কমিয়ে দেওয়ায় ডলারের সুদের হার কিছুটা কমেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর জন্য ডলার জমা রাখার তুলনায় টাকায় বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা করার সুযোগ রয়েছে। এসব কারণে তারা ডলার ছেড়ে দিয়ে টাকার ব্যালান্স বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।
টাকার তারল্য ভালো রাখতে ব্যাংকগুলো ডলার ব্যালান্স কমাতে পারে—এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে ভালো সুদ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকের তারল্যের একটা অংশ সেখানে চলে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোকে তাদের তারল্য মেইনটেইন করতে ডলার ব্যালান্স কমাতে হচ্ছে।
'আবার অনেক ব্যাংকের আমদানির পেমেন্ট শিডিউল করা থাকে। এসব পেমেন্টের ম্যাচুরিটি ডেট চলে আসায় পেমেন্ট করে দিতে হচ্ছে। ফলে ব্যালেন্স কমে যাচ্ছে। এর বাইরে ডলারের বাজারে চাহিদা বাড়ার বিষয়টি তো আছেই।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিপিএম৬ মানদণ্ড অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৮.৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত ৩০ অক্টোবর ছিল ১৯.৮৭ বিলিয়ন ডলার।
বিপিএম৬ হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিমাপের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী, এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দেশগুলোর রিজার্ভ হিসাব ও প্রকাশ করতে হয়।