কারসাজি ঠেকাতে রিয়েল-টাইম ফরেক্স রিপোর্টিং চালুর পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে কারসাজি রোধে ও স্বচ্ছতা বাড়াতে— ব্যাংকগুলোতে ডলার ক্রয় ও বিক্রয়ের রিয়েল-টাইম রিপোর্টিং চালু করার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১১টি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের 'ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রাঞ্জেকশন মনিটরিং অ্যান্ড লাইভ রিপোর্টিং ফরম্যাট' শীর্ষক এক সভায় এ তথ্য জানানো হয়। এসব ব্যাংকের মধ্যে একটি শীর্ষস্থানীয় বিদেশি ব্যাংক, দুইটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বাকিগুলো বেসরকারি ব্যাংক।
বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তা ও ব্যাংকাররা জানান, সভায় রিয়েল টাইম রিপোটিং ছাড়াও ডলারের রেফারেন্স রেট, এক্সপোর্ট বিল ডিসকাউন্টিং, ডলারের ফরোয়ার্ড রেট নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, 'স্থানীয় মুদ্রার (টাকা) আন্তঃব্যাংক বাজার লেনদেনসহ অনেক ধরণের তথ্য আমরা অনেক আগে থেকেই রিয়েট টাইমে পেয়ে আসছি। তবে ডলার মার্কেটের লেনদেনের চিত্র পেতে – আমাদের বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। এসব কারণে ডলার মার্কেট অস্থিতিশীল হলে— তার পুরো চিত্র পেতে দেরী হয়। সবকিছু বিবেচনায় আমরা ফরেক্স মার্কেটের (বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের) লেনদেনের রিয়েল টাইম ডেটা পেতে একটি প্ল্যাটফর্ম করার কথা চিন্তা করছি, যেখানে গ্রাহক পর্যায় এবং আন্তঃব্যাংক পর্যায়ের লেনদেনের তথ্য থাকবে। তবে এটি এখনো আইডিয়া জেনারেশন পর্যায়ে আছে। তাই বেশকিছু ব্যাংকের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।'
২০২১ সালের ডিসেম্বরে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদে টাকা ধার ও আমানতের সুবিধার্থে—- ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) জন্য 'ইলেক্ট্রনিক ডায়েলিং সিস্টেম (ইডিএস) চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের লেনদেন নিষ্পত্তি হয়ে থাকে, যারমধ্যে কলমানি বাজার ও আন্তঃব্যাংক রেপো-ও রয়েছে। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংক যে ধার নেয়, তাকে ইন্টার ব্যাংক রেপো বা আন্তঃব্যাংক রেপো বলা হয়। এই বাজারে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) সুদের হার ও ধার দেওয়া তহবিলের ম্যাচিউরিটি উল্লেখ করে।
ডলারের প্রস্তাবিত ইডিএসটি'র আওতায় শুরুতে স্পট ক্রয় ও বিক্রয়, রেমিট্যান্স ও আন্তঃব্যাংক ক্রয়, বিক্রয় ও আমানতের লেনদেন থাকতে পারে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলারের রিয়েল টাইম রিপোর্টিং চালু হলে বাজার তথ্য সবার মধ্যে পৌঁছানো করা সম্ভব হবে। এটি আদতে রেমিট্যান্স এগ্রিগেটরদের কারসাজি করার সুযোগ কমিয়ে দেবে। একইসঙ্গে দেশের ফরেক্স মার্কেটের মধ্যে আন্তর্জাতিক ফরেক্স মার্কেটের একটা সমন্বয়ও হবে। সবশেষে এই রিয়েল টাইম রিপোটিং দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথাযথভাবে চালু হলে, তা থেকে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে।
এগ্রিগেটররা মূলত ডলার ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, এজন্য একাধিক উৎস থেকে তারল্য একত্রিত করে ডলারের প্রতিযোগিতামূলক দর দিয়ে থাকে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, সভায় ফরেক্স মার্কেটের (বৈদেশিক মুদ্রাবাজার) জন্য রিয়েল-টাইম রিপোর্টিং নিয়ে আলোচনা হলেও— পরিচালনগত জটিলতার কারণে ক্রস-কারেন্সি রেট শুরুতে চালু করা হবে না। তবে ভবিষ্যতে ক্রস-কারেন্সি রেট যুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।
এরমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমবারের মতো ডলারের রেফারেন্স রেট ঘোষণা করা শুরু করেছে। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট স্পট রেফারেন্স এক্সচেঞ্জ রেট (আরআর) হলো— দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ১ লাখ মার্কিন ডলার বা তার বেশি এফএক্স স্পট লেনদেন থেকে প্রাপ্ত একটি লেনদেন-ভিত্তিক গড় হার।
রোববার দিনশেষে এই রেট বা দর ছিল ১২১ টাকা ৪০ পয়সা। দিনে দুইবার ডলারের এই দর ঘোষণা করা হবে।
এদিকে রেফারেন্স রেট ঘোষণা করা হলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলার লেনদেনে— আপাতত এর কোনো কার্যকারিতা নেই বলে সভায় ব্যাংকগুলোকে জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, 'আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় কিছু শর্ত পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ডলারের রেফারেন্স রেট ঘোষণা করা। সেই শর্ত পালন করতেই রেফারেন্স রেট চালু করা হয়েছে। তবে আপাতত লেনদেনে এর কোনো প্রভাব না থাকলেও— রেটটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাজার সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে।'
সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলো বেশকিছু দাবিও রেখেছে। ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমানে ডলারের ৯০ দিনের ফরোয়ার্ড ক্রয় ও বিক্রয় করা যায়। এটিকে বাড়িয়ে ১৮০ দিন করার দাবি জানানো হয়েছে। কারণ, পণ্য আমদানির যেসব ডেফার্ড এলসি খোলা হয় তার একটা বড় অংশই ১৮০ দিনের। ফলে ফরোয়ার্ডের সময়সীমা বাড়ানো হলে তা ব্যাংক ও গ্রাহক, দুপক্ষের জন্যই ভালো হবে।
এছাড়া ফরোয়ার্ডে ডলার কেনাবেচা করা নিয়েও জটিলতা রয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত ফরোয়ার্ড মার্কেট নিয়ে গাইডলাইন দেবে বলে জানিয়েছে ব্যাংকগুলোকে।
অন্যান্য দাবির বিষয়ে সভায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করছেন উল্লেখ করে দাবিগুলো ব্যাংকগুলোর টপ ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার'স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) বা অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে জানানোর জন্য পরামর্শ দেন।