ভোলা দ্বীপে শিল্প স্থাপনে সাফল্যের নজির শেলটেক সিরামিকসের
প্রত্যন্ত ভোলা দ্বীপে কারখানা স্থাপনের কৌশল শেলটেকের জন্য দারুণ ফল বয়ে এনেছে।
ভোলায় টাইলস উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে সিরামিক শিল্পে পা রাখে এই রিয়েল এস্টেট জায়ান্ট। প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ, সস্তা জমি, সহজ নৌপরিবহন ব্যবস্থা এবং গ্রাহকদের বিপুল সাড়া ও বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে প্রথম ইউনিট স্থাপনের দুই বছরের মধ্যে এখন সেখানে আরও দুটি প্লান্ট স্থাপন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
নতুন প্লান্ট দুটোর সিরামিক টাইলস উৎপাদন ক্ষমতা প্রথম প্লান্টের তিনগুণ। এ বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের শেষের দিকে প্লান্টগুলো উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
নতুন ইউনিটগুলো উৎপাদনে গেলে শেলটেক সিরামিকসের মোট দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৪.২০ লক্ষ বর্গফুট টাইলস। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দেশের শীর্ষ টাইলস নির্মাতাদের কাতারে নাম লেখাবে।
নতুন ইউনিটগুলো মূলত 'হাই-ভ্যালু ইমপোর্ট সাবস্টিটিউট' হিসেবে বড় আকারের ফ্লোর টাইলস, দীর্ঘস্থায়ী স্ক্র্যাচ-প্রতিরোধী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্লোর টাইলস এবং ডাবল চার্জিং টাইলস উৎপাদন করবে বেশি।
আগামীতে এ কারখানাগুলোতে স্যানিটারি পণ্য ও থালাবাসন উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, উৎপাদন দক্ষতা যাচাই করার জন্য নতুন প্লান্টগুলোতে ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। 'আশা করছি প্লান্টগুলো সময়মতোই বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।'
নৌপরিবহন সহজ করতে এবং পণ্য পরিবহনের জন্য একটি কার্গো জাহাজ আনার উদ্দেশ্যে কোম্পানিটি কারখানা প্রাঙ্গণের পাশে একটি ব্যক্তিগত নৌ-জেটি স্থাপন করেছে।
কুতুবুদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমরা ১মি.×১মি. ফরম্যাটের সবচেয়ে বড় আকারের ফ্লোর টাইলস উৎপাদন করতে যাচ্ছি, যা বর্তমানে সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর।'
তিনি বলেন, কারখানাটির স্ক্র্যাচ-প্রতিরোধী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্লোর টাইলস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এ টাইলস প্রধানত গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এখানে উৎপন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্লোর টাইলস তিন টন পর্যন্ত ভর বহন করতে পারবে এবং টেকসই হবে।
কুতুবউদ্দিন আরও বলেন, 'কারখানাগুলো ডাবল চার্জিং টাইলস উৎপাদনে সক্ষম, যা একইসাথে প্রিমিয়াম কোয়ালিটি এবং হাই-ভ্যালু প্রোডাক্ট।'
তিনি বলেন, দুই স্তরের টাইলস একসঙ্গে মিশিয়ে ডাবল চার্জিং টাইল তৈরি করা হয়। ফলে এ টাইলগুলো অনেক মোটা ও মানসম্পন্ন হয়ে থাকে।
ভোলার প্রথম শিল্প
ভোলা সদরের প্রায় ৬০ একর জমিতে স্থাপন করা হয়েছে শেলটেক সিরামিক কারখানাগুলো। এতে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। শিল্পটি প্রায় ১ হাজার মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে ৮০০ জনই স্থানীয়।
জলবেষ্টিত ভোলা জেলার প্রথম শিল্প এটি। পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং কম খরচে নৌপরিবহনের ব্যবস্থা রয়েছে, এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে ইচ্ছুক যেসব বিনিয়োগকারী, তাদের জন্য এই পদক্ষেপ অনুপ্রেরণামূলক হতে পারে বলে মনে করছে শেলটেক গ্রুপ।
শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমরা লক্ষ করেছি, সিরামিক শিল্পের অনেক উদ্যোক্তাকে তাদের কারখানার জন্য গ্যাস সংযোগ পেতে তিন-চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সংযোগ পাওয়ার পরেও পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে কাউকে কাউকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
'আমাদের লক্ষ্য সিরামিক শিল্পে নেতৃত্ব দেওয়া। এ কারণেই আমরা এমন একটা এলাকা খুঁজছিলাম যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া যায়। এদিক থেকে ভোলাই সবচেয়ে ভালো জায়গা।'
তিনি বলেন, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও হবিগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে কারখানা সম্প্রসারণের জন্য জমির অভাব রয়েছে। 'এগুলো খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।' এছাড়া এসব এলাকায় জমির দামও অনেক বেশি।
সিরামিক কারখানা স্থাপনের জন্য ভোলাকে বেছে নেওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, 'ভোলা অনুন্নত এলাকা, এবং এখানে সস্তায় পর্যাপ্ত জমিও পাওয়া যায়।'
কুতুবুদ্দিন আহমেদ জানান, গোটা বিশ্বেই অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার তুলনায় নৌপথে পরিবহন অনেক সস্তা। আর এই সাশ্রয়ী পরিবহনের সুবিধা গ্রহণের জন্য ভোলা সবদিক থেকে আদর্শ স্থান।
তিনি আরও বলেন, 'লক্ষ্মীপুর, যশোর ও নারায়ণগঞ্জে আমাদের তিনটি গুদাম আছে। তাই ভোলার কারখানা থেকে আমাদের তৈরি পণ্য খুব সহজেই ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যে জলপথে এই গুদামগুলোতে পাঠানো যায়। কোনো যানজট নেই, পরিবহন খরচও কম।'
স্থানীয়দের জন্য আশীর্বাদ
শেলটেক সিরামিকসে যেসব স্থানীয় লোক চাকরি পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বেকার ছিলেন। এই স্থানীয় কর্মচারীদের একজন জসিম উদ্দিন। তিনি এখন কারখানায় সিনিয়র হেল্পার হিসেবে কাজ করছেন।
জসিমের বাবা কৃষক। তার নিজের কোনো জমি নেই। বর্গাচাষ করে যে সামান্য রোজগার হতো, তা দিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারটিকে জীবিকা নির্বাহ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। শেলটেক সিরামিকস টাইলস কারখানা স্থাপন হওয়ার পর তাদের ভাগ্য ফিরে গেছে।
জসিম উদ্দিন বলেন, 'স্নাতক শেষ করার পর আমি বেকার বসে ছিলাম। শেলটেকের কারখানা চালু হওয়ার পর আমি সেখানে যোগ দিই। এতদিন আমার পরিবার থেকে একমাত্র আমিই চাকরি করে পরিবারকে সাহায্য করছিলাম।
'এই বছর আমার ছোট ভাইও এই কারখানায় হেল্পার হিসেবে যোগ দিয়েছে। এই শিল্প আমাদের জীবনকে সহজ করেছে।'
সিরামিক শিল্পে আসার কারণ
বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট এবং আবাসন শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ শেলটেক (প্রাইভেট) লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮ সালে।
রিয়েল এস্টেট খাতের বিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিরামিক পণ্যের চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে দেখে শেলটেক গ্রুপ বুঝতে পারে, সিরামিক পণ্য উৎপাদন-ব্যবসার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
কুতুবুদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমাদের ধারণা ছিল এটা একটা বড় খাতে পরিণত হবে; এজন্যই আমরা এই শিল্পে পা রেখেছি।'
শেলটেক সিরামিকের প্রথম প্লান্টটি দৈনিক ১.০৭ লাখ বর্গফুট প্রিমিয়াম মানের দেওয়াল ও মেঝের টাইলস উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে উৎপাদন শুরু করে। শেলটেকের ব্র্যান্ড ভ্যালুর সুবাদে কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি তাদের সব পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে।
শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করতে তারা দুটি এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন করেছেন। এর ফলে বর্জ্যও পুনর্ব্যবহার করা যাচ্ছে।
নীতিমালা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ
স্থানীয় সিরামিক পণ্য প্রস্তুতকারকদের জন্য পণ্য রপ্তানি ও বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে অংশ নেওয়ার পথে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো সরকারি নীতিমালা।
কর্তৃপক্ষ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পের মতো প্রকল্পগুলোতে আমদানিকৃত টাইলস ব্যবহারের শর্ত আরোপ করেছে জানিয়ে কুতুবউদ্দিন বলেন, সরকারের উচিত মেগা প্রকল্পগুলোতে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন টাইলস ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া।
শেলটেক চেয়ারম্যান জানান, তারা সর্বাধুনিক ইউরোপীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বমানের টাইলস উৎপাদন করছেন।
স্থানীয় নির্মাতাদের মোট দেশীয় চাহিদা পূরণের ক্ষমতা রয়েছে। তাই টাইল আমদানির ওপর বেশি শুল্ক আরোপের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'দুর্ভাগ্যবশত সিরামিক শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানির ওপর আরোপ করা মোট শুল্কের পরিমাণ উৎপন্ন পণ্য আমদানির খরচের চেয়েও বেশি।
'হাই-ভ্যালু টাইলস শিল্পে এখন ইউরোপীয় উৎপাদকরা ছড়ি ঘোরাচ্ছে। সরকার যদি স্থানীয় টাইল উৎপাদকদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়, তাহলে এই খাত রপ্তানি আয়ের ভালো উৎসে পরিণত হতে পারে।'
শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান হতাশা প্রকাশ করে বলেন, গ্রামাঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য পোশাক খাত যে সরকারি কর অবকাশ সুবিধা পায়, সেই সুবিধা সিরামিক শিল্প পাচ্ছে না।