সিন্ডিকেটের হাতে চাল ব্যবসা, কৃত্রিমভাবে সরবরাহ কমানোয় বাজার ঊর্ধ্বমুখী
দেশে আমন মৌসুমের ধান কাটা শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন মোকামে নতুন মৌসুমের চাল সরবরাহ ও সরকারি পর্যায়ে সংগ্রহ শুরু হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ ঘাটতি দেখিয়ে হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়েছে চালের বাজার। সংকট দেখিয়ে বাজারকে চাঙ্গা রাখতে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাইকারি ব্যবসায়ীদের।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি দুই থেকে চার টাকা। মূলত সরকারি পর্যায়ে চাল সংগ্রহের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন মোকাম থেকে চাল সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনিতে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। কিন্তু নতুন মৌসুমের চাল সরবরাহ শুরু হলে বাজারে সংকট দেখানো হচ্ছে মোকামগুলো থেকে। যার কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
খাতুনগঞ্জের চাক্তাই বাণিজ্যিক এলাকার বিভিন্ন আড়তের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়ে গেছে। এর মধ্যে স্বর্ণা সিদ্ধ চালের বস্তাপ্রতি দাম ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকায়, মিনিকেট সিদ্ধ মানভেদে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, পাইজাম সিদ্ধ ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, কাজলতা সিদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৭০০ টাকায়, জিরাশাইল সিদ্ধ ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯৫০ টাকা দরে। অপর দিকে আতপ চালের মধ্যে মিনিকেট বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়, বেতি সিদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে মানভেদে ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, ইরি আতপ ১৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বস্তাপ্রতি ১ হাজার ৯৫০ টাকায়, কাটারি আতপ ৩০০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে। পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে খুচরা বাজারেও চালের দাম কেজিপ্রতি কয়েক টাকা করে বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশীয় কৃষকদের উৎপাদিত চালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গত এক মাস ধরে বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি আপাতত বন্ধ রয়েছে। যার কারণে আমদানিকৃত বিদেশী চাল বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে সরবরাহকারীরা। বাংলাদেশে বর্তমানে ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি চাল আমদানি হওয়ায় এবং ভারতীয় চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশীয় চালের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, দেশে নতুন মৌসুমের ধান-চাল বাজারে আসলেও এখনো সরবরাহ খুব বেশি বাড়েনি। আমদানিকৃত ভারতীয় চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশীয় বাজারেও পণ্যটির দামে প্রভাব বেড়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেল ডিজেলসহ বিশ্ববাজারে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাবও চালের বাজারে পড়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে চলতি খাদ্য সংগ্রহ মৌসুমে সরকার ৩ লাখ টন ধান ও ৫ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ধান-চাল সংগ্রহের এই কর্মসূচি চলবে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরমধ্যে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৬৫ শতাংশ, ৩১ জানুয়ারি ২০২২ এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ধান-চাল সংগ্রহের শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায় খাদ্য বিভাগ।
গত ৮ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খাতুন স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে, অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহ নীতিমালা-২০১৭ অনুসারে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়। নির্দেশনার আলোকে ইতোমধ্যে মিলারদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে আমন ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য প্রতি কেজি ২৭ টাকা, চালের মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইতোমধ্যে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৬৫২ টন আমন ধান ও ৭৪ হাজার ৩৭৫ টন সিদ্ধ আমন চাল যা চালের আকারে সর্বমোট ৭৬ হাজার ১৩৭ টন ধান-চাল সংগ্রহ করেছে সরকার।
জানতে চাইলে চাল ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রাম রাইস মিল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, সরকার ধান-চাল সংগ্রহে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষকদের ক্ষেত্রে দাম ১ টাকা বাড়ালেও মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহে কেজিপ্রতি ৩ টাকা দাম বাড়িয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণেও দেশে চালের দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। মিল মালিকদের কাছ থেকে সরকারি ক্রয়ের দাম বাড়ানোর ফলে খোলাবাজারে কৃষকদের চাল না আসায় উৎপাদন মৌসুমেও পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চালের দাম নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে বলে মনে করছেন তিনি।