নীরবে আকাশছোঁয়া এক শিল্প
শতভাগ বিদ্যুতায়ন, ব্যাপক নগরায়ন, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সরকারের প্রণোদনায় এক দশকে পাঁচগুণ বড় হয়েছে দেশে ইলেকট্রিক পণ্যের বাজার।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র এক দশকে বাজারের পরিধি বার্ষিক ৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একে প্রায় শূন্য থেকে শিখরে আরোহন বলে অভিহিত করছেন তারা।
পণ্যের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বিপুল কর্মসংস্থানও তৈরি করেছে দেশের ইলেকট্রিক খাত। নতুন বিনিয়োগে কর ছাড়ও ইলেকট্রিক পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০১০ সালের পর গত এক দশকে দেশে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে ৫-৬ গুণ। পরিবর্তন এসেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আবাসনে। দৈনন্দিন কাজে হয়েছে অনেক বেশি যান্ত্রিকীকরণ। জীবনে অত্যাবশ্যকীয় বৈদ্যুতিক পণ্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে সৌখিনতা। কল-কারখানায় বেড়েছে ইলেকট্রিক পণ্যের চাহিদা। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে তৈরি হয়েছে ইলেকট্রিক, হার্ডওয়্যার ও মেশিনারির বড় বাজার।
এনিয়ে বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মঈনুল ইসলাম ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, নগরায়ন ও দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে নীরবেই বড় হয়েছে ফ্যান, লাইট, সুইচ, কেবল, ওয়্যার, সার্কিট ব্রেকার, জেনারেটরের মতো পণ্যের বাজার। বিনিয়োগ করেছে ওয়ালটন, প্রাণ-আরএফএল, এনার্জিপ্যাক, এসিআই, বিডি ল্যাম্পস, মোহাম্মদী ইলেকট্রিক, বিআরবি, বিবিএস, পারটেক্স, প্যারাডাইস, মাইওয়ানের মতো বড় কোম্পানি। আড়াই হাজারের বেশি ছোট উদোক্তাও এখাতে বিনিয়োগ করেছে।
তিনি জানান, ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলি এখন স্থানীয় চাহিদার ৫০ শতাংশ পূরণ করে। আর স্থানীয় এবং আমদানি করা উভয় ধরনের নন-ব্র্যান্ড পণ্য বাকিটা পূরণ করে।
দেশজুড়ে সফল বিদ্যুতায়ন এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি- ফ্যান, লাইট, সুইচ, সার্কিট ব্রেকার, কেবল ও জেনারেটরের মতো ইলেকট্রিক পণ্য বাজার বিকাশের পেছনে বড় অবদান রেখেছে বলেও উল্লেখ করেন মঈনুল ইসলাম।
সরকারের পাওয়ার ডিভিশনের তথ্যানুযায়ী, এখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াট। ২০১০-১১ সালের তুলনায় এটি প্রায় ৫ গুণ। ৪ কোটি ৬৪ লাখ গ্রাহক এবং প্রায় শতভাগ পরিবার বিদ্যুতের আওতায় এসেছে।
অন্যদিকে, মাথাপিছু আয় ৭৫০ ডলার থেকে ২৫০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রি করছেন ৬০ হাজার খুচরা ব্যবসায়ী:
ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রিতে সারাদেশে খুচরা দোকানও গড়ে উঠেছে প্রায় ৬০ হাজার। মঈনুল জানান, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত ৪-৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
ইলেকট্রিক পণ্য বাজারের ১৮ শতাংশ দখলে নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে প্রাণ-আরএফএল। গ্রুপটির মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল জানান, নিত্য ব্যবহারযোগ্য পণ্যের সাথে এখন যোগ হয়েছে সৌখিন ও দামি পণ্যের চাহিদা। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিপুল চাহিদাও এ খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
২০১২ সালে বৈদ্যুতিক পণ্যের ব্যবসা শুরু করে আরএফএল এখন বিদ্যুতায়নের কল্যাণে ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করছে।
সিলিং ফ্যান দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে উৎপাদন করছে ফ্যান, লাইট, সুইচ, সকেট, সার্কিট ব্রেকার, কেবলস, ব্যাটারি এবং ইলেকট্রিক্যাল এক্সেসরিজ ক্যাটাগরিতে ১২০০ এর অধিক পণ্য।
কামরুজ্জামান বলেন, 'আমাদের বিজলী, ক্লিক, ব্লেইজ ব্র্যান্ডের পণ্য গুণগত মানে বিদেশি ব্র্যান্ডের চেয়েও ভালো। বছরে প্রবৃদ্ধিও ২০ শতাংশের বেশি। আগামীতে অন্তত পাঁচ বছর এই প্রবৃদ্ধি বজায় থাকার আশা করছি।'
'মহামারি আমাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলেনি, কারণ লকডাউনে ইলেকট্রিক পণ্য চাহিদা কমেনি।' প্রাণ-আরএফএল এর উৎপাদন ও বিপণণে এখন প্রায় ৪ হাজার জনের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানান কামরুজ্জামান।
বিদ্যুতায়নের পাশাপাশি ইলেকট্রিক খাতের জন্য সরকারের দেওয়া ১০ বছর কর অবকাশ এ খাতের বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন ওয়ালটন ইলেকট্রনিক্সের ইলেক্ট্রিক বিজনেস অপারেশন চিফ সোহেল রানা। তিনি জানান, কাঁচামাল আমদানিতেও শুল্ক কমানোয় বাজার প্রবৃদ্ধিমুখী হয়েছে।
২০১৬ সালে ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদনে নামে দেশে ইলেট্রনিক্স খাতের জায়ান্ট ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি।
এখন গ্যাং সুইচ, স্মার্ট সুইচ, এক্সটেনশন সকেট, পিয়ানো সুইচ, সার্কিট ব্রেকার, ডিবি বক্স, ফ্যান হুক বক্স, হোল্ডার ও সিলিং রোজ, ইউপিভিসি বৈদ্যুতিক পাইপ ও ফিটিংস, হার্ডওয়্যার এবং এক্সেসরিজসহ হাজারের বেশি পণ্য উৎপাদন করছে কোম্পানিটি।
কোম্পানির এ ব্যবসায় পাঁচ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে উল্লেখ করে সোহেল রানা বলেন, আমাদের লক্ষ্য এখন আন্তর্জাতিক বাজার। গত মাসেই আমরা আফ্রিকার বাজার ঘুরে এসেছি। সেখানে আমাদের পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পাশ্ববর্তী নেপাল ও ভূটানেও রয়েছে দারুণ সম্ভাবনা।
বাজার অংশীদারিত্বে এগিয়ে থাকা আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান- এনার্জিপ্যাক। বর্তমানে কোম্পানিটি ৫০০ ধরনের ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদন করছে। তাদের বাজার দখল ৫-৬ শতাংশ। গত এক দশকে কোম্পানির ব্যবসাও উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ লক্ষ্য করেছে।
এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও পরিচালক নুরুল আক্তার জানান, ধীরে ধীরে সব ধরণের বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদনে যাচ্ছে এনার্জিপ্যাক।
তিনি বলেন, 'আমরা এখন ভারতে রপ্তানি করছি। আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানিতেও আমাদের রয়েছে বিপুল সুযোগ।'
এনার্জিপ্যাকের পরিচালক হুমায়ুন রশিদ বলেন, কোম্পানিটি ১২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এবং ৪ হাজার ৭০০ জনকে নিয়োগ দিয়েছে।
গত এক দশকে বাজারের আরেকটি বড় কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মোহাম্মদী ইলেকট্রিক্স। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় এখন ৪৩০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। প্রায় ১,৬০০ ধরণের পণ্য উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারের ৮ শতাংশ দখলে রয়েছে তাদের।
এছাড়া বিআরবি ও বিবিএসের উভয় কোম্পানির ন্যূনতম ৪ শতাংশ করে বাজার অংশীদারিত্ব রয়েছে।
৫০ শতাংশ নন-ব্র্যান্ডেড পণ্য:
নন-ব্র্যান্ড স্থানীয় এবং আমদানিকৃত পণ্য ইলেকট্রিক পণ্য বাজারের ৫০ শতাংশ দখল করেছে।
দেশের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রিক মার্কেট নবাবপুরে বর্তমানে ইলেকট্রিক পণ্যের প্রায় পাঁচ হাজার ছোট-বড় দোকান গড়ে উঠেছে। তারা সব ধরনের বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রি করলেও বেশিরভাগই নন-ব্র্যান্ড।
এ বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, ব্র্যান্ডের পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় তারা ছোট উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন।
নবাবপুরের তাজ ইলেকট্রিকের মালিক সাইফুদ্দিন জনি বলেন, 'আমাদের এখানে ছোট কারখানায় উৎপাদিত এক ডজন সকেট ৫০-৮০ টাকায় ক্রয় করা যায়। বড় ব্র্যান্ড থেকে একই মানের সকেট কিনতে ১৫০-২০০ টাকা খরচ করতে হয়। ফলে এসব পণ্যে মুনাফা থাকে না।'
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নন-ব্র্যান্ডেড পণ্যের পাশাপাশি এখানে সানপ্লাস, উইনার ডিলাক্স, সুপারস্টোর, ওসাকা, তিশা, সানলাইট, হোসাফ, তোশিবা, বিআরবি, প্যারাডাইস, বিবিএস, সোহানা, সিটি, ফ্যালকন, ট্রান্সটেক, পিএইচবি, স্মার্ট, পদ্মা, এমকে, গ্রামীণ, অনিক, আর কে-সহ বেশ কয়েক হাজার ছোট ছোট ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট বিক্রি করেন তারা।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল বলেছেন, ইলেকট্রিক পণ্যে দামের চেয়ে মান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু আমদানিকারক স্বল্প দামে নিম্নমানের পণ্য বাজারে দিচ্ছে। পাশাপাশি নকল পণ্যে বাজার ছেঁয়ে গেছে। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া দরকার।
ইলেকট্রিক এসব পণ্য দুর্বল মানের হলে অগ্নিকান্ড বা বৈদ্যুতিক শকের ভয় রয়েছে জানিয়ে নিন্ম-মানের পণ্য বিকিকিনি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে মনে করছে বড় ব্র্যান্ডগুলো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. মো. কামরুল হাসান বলেন, উদ্যোক্তা ছোট হোক বা বড়; এসব পণ্য উৎপাদনের টেকনিশিয়ান রাখতে হবে। ছোট ব্র্যান্ড হলেও বাজারে ছাড়ার আগে সব পণ্য যেন মান-সম্পন্ন হয়, সেজন্য একটি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ দরকার।
আড়াই হাজারের বেশি নতুন উদ্যোক্তা:
২০১৪ সালে স্নাতক শেষ করে বন্ধুর পরামর্শে ইলেকট্রিক পণ্যের ব্যবসায় নামেন নবাবগঞ্জের মোবারক হোসেন। চীন থেকে বিভিন্ন আমদানিকারকের নিয়ে আসা পণ্য পাইকারি কিনে মা ইলেকট্রিক নামে দোকান খুলে সেখানে বিক্রি করতেন তিনি।
২০১৫ সালে লাইসেন্স নিয়ে নিজেই আমদানি শুরু করেন মোবারক। পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদকদের পণ্য বিক্রি করছেন। পণ্য আনতে গিয়ে চীনে দেখে আসেন খুব সহজে ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদনের কৌশল। তিনটি মেশিন আমদানি করে ২০১৭ সালে নিজেই উৎপাদন শুরু করেন মোবারক হোসেন।
বর্তমানে নিজেই প্রায় ৮০০ ধরণের ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদনকারী মোবারক হোসেন বলেন, "আমার কারখানায় ৩০-৩৫ জন শ্রমিক কাজ করে। বর্তমানে দৈনিক ৮-১০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করছি।"
মোবারকের মতোই গত ১০ দশ বছরে ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন অনেকে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখাতে এক দশকে ২৫০০'র বেশি নতুন উদ্যোক্তা এসেছে। ৩-৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এখন কোটি টাকার ব্যবসায় মূলধন গড়েছেন অনেকেই।