মানসম্মত কাঁচামালের নিশ্চয়তায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদে ঝুঁকছে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প
দেশে এক কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদন হলেও এর বেশিরভাগই চিপস তৈরির জন্য উপযোগী নয়। কিন্ত ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে চিপস তৈরির উপযোগী আলুর সরবরাহ নিশ্চিত করার কোন বিকল্পও নেই। এ পরিস্থিতিতে চিপস তৈরির জন্য 'কারেজ' নামে আলুর একটি ভ্যারাইটি কৃষকদের দিয়ে উৎপাদন করিয়ে নিচ্ছে বোম্বে সুইটস।
মানসম্মত কাঁচামালের সরবরাহ ঠিক রাখতে বোম্বে সুইটস এভাবেই কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ শুরু করে প্রায় এক যুগ আগে। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং অর্গানাইজড উপায়ে সর্বপ্রথম কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর শুরুটাও এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই।
বর্তমানে অবশ্য কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের এই চর্চা শুরু করেছে ফুড প্রসেসিং এ জড়িত প্রথম সারির অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান। প্রাণ, এসিআই, বসুন্ধরা, বেঙ্গল মিট, ব্র্যাক, আকিজসহ অনেকগুলো কোম্পানিই এখন কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, মানসম্মত পণ্য তৈরির জন্য কাঁচামালের একটা নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড থাকা জরুরি। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণে কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ সরবরাহ ঠিক না থাকলে উৎপাদনের উপরও এর প্রভাব পড়বে। এসব নিশ্চয়তার জন্যই মূলত প্রতিষ্ঠানগুলো কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এ গুরুত্ব দিচ্ছে।
এছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের জন্য একসঙ্গে যে পরিমাণ পণ্য প্রয়োজন তা একসঙ্গে একই মানের পাওয়া যায়না বলেও অনেকে এখন কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এ ঝুঁকছে।
এতে অবশ্য কৃষকরাও লাভবান হচ্ছে। কারণ কন্ট্রাক্টে চাষাবাদ করলে পণ্যের একটা নির্দিষ্ট দাম সবসময়ই পাওয়া যায়। বাংলাদেশে যেখানে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বেড়ে গেলে পণ্যের দাম কমে যাওয়ার প্রবণতা বেশি সেখানে কৃষকরা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এ একটা নির্দিষ্ট দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা সবসময়ই পেয়ে থাকে। যদিও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই পণ্যের দাম ঠিক করে।
এ বিষয়ে বোম্বে সুইটস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার খুরশিদ আলম ফরহাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রতি বছর ১২-১৩ হাজার টন আলু দরকার হয় চিপস তৈরির জন্য। এত কোয়ালিটি মেইনটেইন করে এত আলু যোগান ঠিক রাখতে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর বিকল্প নেই। আমাদের নিজস্ব জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি ১০-১২ বছর আগে আমরা এটা শুরু করি। এখন কয়েকশ কন্ট্রাক্ট ফার্মার রয়েছে, যারা আলু চাষ করছে।"
তিনি বলেন, "আমরা কৃষকদের কোয়ালিটি বীজ সরবরাহ করি যাতে করে আলুর মানটাও ভালো হয়। আবার তাদের কাছ থেকে সবসময় একটা ফিক্সড দামেই আলু কিনি। এতে করে বাজার পড়ে গেলেও তারা লোকসানে পড়ে না।"
প্রথম সারির ফুড প্রসেসর ইন্ডাস্ট্রি প্রাণের কন্ট্রাক্ট ফার্মার সবচেয়ে বেশি। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সারাদেশে এক লাখেরও বেশি কৃষক জড়িত। ডেইরী পণ্য হিসেবে দুধ, চাল, টমেটো, বাদাম, ডাল, আম, হলুদ, মরিচসহ নানা পণ্য এ পদ্ধতিতে সংগ্রহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশ বিদেশ থেকে সোর্সিং করে কৃষকদেরকে বীজ সরবরাহ করা হয়। একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট টিম দিয়ে সুপারভিশনও করা হয়ে থাকে উৎপাদন পর্যায়ে।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাজারে গেলে একই মানের ক্রপ পাওয়া দুষ্কর। অনেক নন-স্ট্যান্ডার্ড ক্রপ পাওয়া যায়। আমরা যেহেতু ভালো মানের বীজ সরবরাহ করি সেজন্য প্রডাক্টও ভালো পাওয়া যায় আমাদের কৃষকদের কাছ থেকে। আবার আমরা র-মেটেরিয়ালসের সোর্সটা সম্মন্ধেও জানতে পারি।"
তিনি বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য নেয়ায় মিডলম্যানদের খরচটাও বাঁচানো যাচ্ছে। এর একটা অংশ কৃষক তার পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড দাম হিসেবে পেয়ে যাচ্ছে।
বসুন্ধরা কয়েক মাস হলো প্যাকেটজাত মশলা উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি হলুদ, মরিচ, জিরা ও ধনে দিয়ে বাজারজাত শুরু করেছে। এই চারটি মশলাই বসুন্ধরা কন্ট্রাক্ট ফার্মার দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে।
বসুন্ধরার চিফ অপারেটিং কর্মকর্তা (ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিং) জসিম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর সুবিধাটা হলো আমরা সোর্সটা সম্মন্ধে জানি। এ থেকে কি মানের প্রডাক্ট উৎপাদন হবে সেটাও আমরা বুঝতে পারি। অন্যদিকে কৃষকরাও একটা ভালো দাম পায়।"
মিট প্রসেসিং খাতের প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মিট। প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজারের বেশি কন্ট্রাক্ট ফার্মার রয়েছে যারা সারা বছর গরু সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহ করা ৪০০ মে. টন মাংসের অর্ধেকই আসে এসব কন্ট্রাক্ট ফার্মারদের কাছ থেকে। খামারিরা এই গরুগুলো পালন করছে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গাইডলাইন মেনে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি বাজারে 'সেইফ মিট' বিশেষণে মাংস বিক্রি করে।
প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড ধরে রেখে উৎপাদন বাড়াতে সরবরাহ লাইনে কন্ট্রাক্ট ফার্মার বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেঙ্গল মিটের সিইও এ এফ এম আসিফ টিবিএসকে বলেন, "আমরা একটা নির্দিষ্ট দাম দেই উৎপাদনকারীদের। মাংসের বাজার বেড়ে গেলেও আমরা বাড়তি দাম দিই না। কারণ তারা সবসময় আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট লাভে পণ্য দিচ্ছে। আমাদের উপর আস্থা তৈরি হয়েছে।"
তিনি বলেন, "কোয়ালিটি মিট প্রডিউসের জন্য আমরা এসব খামারিদের বাইরে যেতে পারি না। কারণ অন্যদের গরু পালন পদ্ধতি, রোগ বালাই সহ নানান জটিলতা থাকে। এজন্য তাদের উপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়।"
প্রাণ, আকিজ, আড়ং ও মিল্ক ভিটা দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষে। মিল্ক ভিটা খামাড়িদের নিয়ে সমবায় পদ্ধতিতে চললেও অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানই কন্ট্রাক্ট ফার্মারদের কাছ থেকেই দুধ সংগ্রহ করে থাকে। যদিও দুধের দাম নিয়ে খামারিদের মধ্যে কিছু অসন্তোষের ঘটনা নতুন নয়। তারপরও প্রসেসর কোম্পানির কারণেই অনেকে গাভী পালন করছে।
পাবনার ভাঙ্গুরা থানার দুগ্ধ খামাড়ি খোকন বিশ্বাস বলেন, "প্রতিদিন খামারে ৫০ লিটারের বেশি দুধ পাই আমি। এত দুধ স্থানীয় বাজারে প্রতিদিন বিক্রি করা সম্ভব নয়। প্রসেসর কোম্পানি নেয় বলেই আমরা টিকে আছি। তবে খরচ বেড়ে গেলেও প্রসেসর কোম্পানিগুলো সহজে দাম বাড়ায় না। এটা আমাদের একটা বড় সংকট।"
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউট (আইএফপিআরআই) মুরগির উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপের ওপর কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত জুনে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে দুটি বিষয় পাওয়া যায়। সাধারণ উৎপাদনকারীর তুলনায় কন্ট্রাক্ট ফার্মারদের আয় বাড়ে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত। সাধারণ পণ্যের তুলনায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এ উৎপাদিত পণ্যের মানও অন্তত ১৩ শতাংশ বেশি থাকে।
তবে ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে কৃষির দুটি উপখাতে ২ লাখের বেশি কন্ট্রাক্ট ফার্মার রয়েছে। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে কোন গবেষণা বা সরকারি কোন সুনির্দিষ্ট ডাটা পাওয়া যায়নি।